রবিবার, ২২ জুন, ২০১৪

বারমুডা নিয়ে যত কথা


ভারতবর্ষ আবিষ্কারের জন্য তিনি অভিযান চালিয়েছিলেন। ভুল করে তাঁর জাহাজ চলে যায় উল্টো দিকে। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সাগর পেরিয়ে যেখানকার মাটিতে নোঙর করেছিল তাঁর জাহাজ, সেটাকেই তিনি মনে করেছিলেন ভারতবর্ষ। পরে ভুল ভাঙে তাঁর। বিশাল ভারতবর্ষ তো দূর অস্ত, তিনি যেখানে পৌঁছান, সে অঞ্চলের আয়তন ভারতবর্ষের ছোটখাটো একটা দ্বীপের সমান। তবে ভুল করে যে দ্বীপ আবিষ্কার করেছিলেন স্প্যানিশ অভিযাত্রী ক্রিস্টোফার কলম্বাস, সেটার নাম তিনি বদলাতে চাননি। তাই পুরো দ্বীপপুঞ্জটার নাম রাখেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ! সাধের ভারত আবিষ্কারের আশা ব্যর্থ হলেও আমেরিকা আবিষ্কারের কৃতিত্ব জুটেছিল তাঁর কপালে।


বড় কোনো অভিযানই নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয় না। কিছু বাধা থাকেই। আমেরিকা আবিষ্কারের পথে কলম্বাসের নাবিকদের মধ্যে জাঁকিয়ে বসেছিল ভৌতিক আলোর জুজু। সেটা একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আটলান্টিক মহাসাগরের ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর আমেরিকা উপকূলের এই এলাকার এক কোনায় বারমুডা দ্বীপ, অন্য দুই কোনা বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের দুটি সাগরসৈকত মিয়ামি ও পুয়ের্তো রিকো। তিন কোনায় এই তিন স্থানকে রেখে যে বিশাল একটা ত্রিভুজের মতো জলাঞ্চল, এটাই এখন বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নামে পরিচিত বিশ্বজুড়ে।

১‌২ অক্টোবর ১৪৯২। ক্রিস্টোফার কলম্বাস তাঁর লগবুকে লিখেছেন, এই ত্রিভুজাঞ্চলজুড়েই নাকি তাঁর নাবিকেরা ভুতুড়ে সব কাণ্ডকারখানা দেখেছেন। এ সময় তাঁদের কম্পাস ঠিকমতো কাজ করছিল না, তাঁরা দেখেছেন ভুতুড়ে আলোর নাচন। এই লগবুকই বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।

পরবর্তীকালে কলম্বাস বিখ্যাত হয়েছিলেন তাঁর দুঃসাহসিক অভিযানের জন্য। তাই তাঁর লগবুকের একটা গুরুত্বও ছিল।

যত রহস্য শয়তানের ত্রিভুজে

৫ ডিসেম্বর ১৯৪৮। মার্কিন নেভির ফ্লাইট নাইন্টিনের পাঁচটি বিমান বেরিয়েছে প্রশিক্ষণে। ছুটছে মহাসাগরের ওপর দিয়ে। কন্ট্রোল বেসের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলছেন মিশনপ্রধান চার্লস টেইলর। রেডিওতে। হঠাৎ কথা বলতে বলতে থেমে যায় টেইলরের কণ্ঠ। নীরবতা ভর করে রেডিওতে। সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। কন্ট্রোল রুম থেকে অনেক চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সংযোগ স্থাপন আর সম্ভব হয়নি। টেইলর বা তাঁর দলের কেউ আর যোগাযোগ করেননি।

শুরু হয় সার্চ মিশন। সেগুলো উদ্ধারের জন্য পাঠানো হয় আরও দুটি বিমান আর একদল দক্ষ ক্রুকে। অনেক খোঁজাখুঁজি করে ব্যর্থ হয়ে ফেরে একটি বিমান। কিন্তু ফেরেনি আরেকটি বিমান। দিনদুপুরে গায়েব! রেডিওর সর্বশেষ সিগন্যাল ট্র্যাক করে জানা যায়, মিয়ামি উপকূলের ওই কুখ্যাত ত্রিভুজ এলাকাতেই হারিয়েছে সব কটি বিমানই। এই প্লেন দুর্ঘটনাই ব্যাপক কুখ্যাতি এনে দেয় বারমুডা ট্রায়াঙ্গলকে। তবে একটু দেরিতে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নৌ দুর্ঘটনাটা ঘটে বারমুডার ট্রায়াঙ্গলে। ১৯১৮ সালের ৪ মার্চ। বার্বাডোজ থেকে ৩০৬ জন যাত্রী নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিচ্ছিল মার্কিন বিমান ইউএসএস সাইক্লোপস। কিন্তু মাঝপথে ওই ত্রিভুজ এরিয়ায় হারিয়ে যায়। অনেক সন্ধান করেও মেলেনি তার সন্ধান। কী হলো তাহলে? তখন এ নিয়ে উচ্চবাচ্য হয়নি। আর দশটা স্বাভাবিক দুর্ঘটনা বলেই মনে করা হয়েছিল এটাকে।

আরেকটু পেছনে ফেরা যাক এবার। ৫ ডিসেম্বর ১৮৭২। মারি সেলেস্ত নামের এক মালবাহী জাহাজ নিউইয়র্ক বন্দর থেকে ছেড়ে যায়। তবে গন্তব্যে পৌঁছায়নি। এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার। বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে জল্পনাকল্পনা, প্রচার কিছুই তখন হয়নি। তাই বারমুডাই যে জাহাজটাকে গিলেছে, সে কথা কেউ ভাবেনি গুরুত্ব দিয়ে। পরে জাহাজটা পাওয়া যায় বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এলাকাতেই। অক্ষত আছে জাহাজের সব জিনিস। কিন্তু নেই জাহাজের মানুষগুলো। জলদস্যুরা মেরেছে, এ কথা বলা যায় না, তাহলে মালসামান অক্ষত থাকার কথা নয়? তাহলে? উত্তর জানা ছিল না সে সময়। ৯ বছর পর আরেকটি ঘটনা রহস্যের আগুনে ঘি ঢালে।

ফ্লাইট নাইনটিনের ক্রু ও প্রশিক্ষণার্থীরা

১৮৮১ সাল। এলেন অস্টিন নামের একটা জাহাজ চলছে আটলান্টিকের বুকে। জাহাজের নাবিকদের চোখে পড়ে একটা পরিত্যক্ত খালি জাহাজ। ইতস্তত ভেসে বেড়াচ্ছে সাগরের বুকে। কৌতূহলী অস্টিনের নাবিকেরা জনশূন্য জাহাজটাকে অনুসরণ করে একসময় ধরেও ফেলেন। হইহই করে সেই জাহাজে নেমে পড়েন অস্টিনের একদল নাবিক। জাহাজে যদি মূল্যবান কিছু মেলে! তা ছাড়া জাহাজটাকে ধরে তাঁরা দেশে নিয়ে যেতে চান। জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেন নাবিকেরা। তারপর দুটো জাহাজ পাশাপাশি চলে নিউইয়র্কের দিকে। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ নয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সদ্য পাওয়া জাহাজটা হারিয়ে যায়। অস্টিনের নাবিকদেরসহ। পরে সেটাকে আবার খুঁজে পান অস্টিনের নাবিকেরা। কিন্তু তাঁদের যে দল ওই জাহাজে নেমেছিল, নিয়েছিল এর নিয়ন্ত্রণ, সেই নাবিকের দলটা যেন বেমালুম গায়েব! কী করা উচিত, ভাবেন নাবিকেরা। সাহায্যের মেসেজ পাঠান কন্ট্রোল বেসে। উদ্ধার করতে যায় আরেকটা দল। কিন্তু সেখানে গিয়ে কিছু পায় না রেসকিউ টিমটা। না এল অস্টিন, না অন্য জাহাজটাএকেবারে গায়েব দুটি জাহাজই। এ ঘটনাও ঘটে ওই রহস্যময় ত্রিভুজেই। কিন্তু সেটা নিয়েও সেকালে বেশি আলোড়ন হয়নি।

রহস্যের পর রহস্য। এরপর তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না। অনেকগুলো ঘটনা পরপর ঘটে। একটার সঙ্গে আরেকটার যোগসূত্র খুঁজে পেতে তখন আর কষ্ট হয় না। সঙ্গে চলে ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি। তখনই সামনে চলে আসে কলম্বাসের সেই লগবুক। দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে তখন আর কসরত করতে হয় না। অনেক অনেক দুর্ঘটনার ফিরিস্তি বের করা হয় ইতিহাসের বুক চিরে।

১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৫০ সাল। দ্য মিয়ামি হেরাল্ড পত্রিকায় একটা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। লেখক এডওয়ার্ড ভ্যান উইনংকল জোনস। সেই লেখাতেই তিনি প্রথম পাঠককুলকে সচেতন করেন বারমুডা ট্রায়াঙ্গল রহস্য নিয়ে। তিনি ওই অঞ্চলকে পরিচয় করিয়ে দেন রহস্যময় ‘স্মল ওয়ার্ল্ড’ নামে। তারপর ইতিহাসের আস্তাকুঁড় থেকে তুলে আনেন একের পর এক রহস্যজনক কেস হিস্ট্রি। বলেছেন দ্য সান্দ্রা নামের একটা মালবাহী জাহাজের নিরুদ্দেশ হওয়ার খবর। সেটাও নাকি হারিয়েছে ওই স্মল ওয়ার্ল্ডে। ১৯৫০ সালের ১৬ জুনের পর সেটা থেকে আর কোনো রেডিও সিগন্যাল পায়নি কন্ট্রোল রুম। এরপর জোনস ফিরেছেন বছর দুয়েক আগে। ফ্লাইট নাইন্টিনের ঘটনা তখনো তরতাজা। ১৯৪৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর। ডগলাস ডিসি ৩ নামে একটা জাহাজ দ্বীপরাজ্য পুয়ের্তো রিকো থেকে ৩২ যাত্রী নিয়ে যাচ্ছিল মিয়ামি দ্বীপে। কিন্তু মাঝপথে লাপাত্তা!

আরও কিছু কেস হিস্ট্রি তুলে ধরে তিনি সিদ্ধান্তে আসতে চেয়েছেন, ওই স্মল ওয়ার্ল্ডে এমন কোনো রহস্য আছে, যার কারণে সেখানে বিমান, জাহাজ লাপাত্তা হচ্ছে। এরপর ১৯৫২ সালে দ্য ফেট ম্যাগাজিনে ‘সি মিস্ট্রি আওয়ার ব্যাকডোর’ নামে একটা ছোট্ট ফিচার লেখেন। সেখানে তিনি তুলে ধরেন ফ্লাইট নাইন্টিনের নিখোঁজের কাহিনি। জনমানসে জমাট বাঁধতে থাকে বারমুডার ত্রিভুজের রহস্য। এরপর এটাকে কিংবদন্তির পর্যায়ে নিয়ে যান মার্কিন লেখক ভিনসেন্ট গ্যাডিস। ১৯৬২ সালে ফ্লাইট নাইন্টিনের ঘটনা তিনি লেখেন রসিয়ে রসিয়ে। তাতে তিনি প্রথম এসব ঘটনার সঙ্গে অতিপ্রাকৃত ঘটনার যোগসাজশ খোঁজার চেষ্টা করেন। আর জোনসের স্মল ওয়ার্ল্ডের নাম পাল্টে লেখার শিরোনাম দেন ‘দ্য ডেডলি বারমুডা ট্রায়াঙ্গল’। ছাপা হয় আমেরিকান লেজিওন ম্যাগাজিনে।

এখানে থামলেও কত দূর গড়াত বারমুডা রহস্যের পানি, কে জানে, দুই বছর পর তিনি লেখেন ইনভিজিবল হরাইজন বা হারানো দিগন্ত নামে একটা বই। সেটিই রহস্যের পালে হাওয়া লাগায়। রহস্য, অলৌকিকতা, ভিনগ্রহী প্রাণীদের কারসাজি ইত্যাদি মিলিয়ে এক ককটেল বই। গ্যাডিসকে অনুসরণ করে আরও অনেক লেখক হুমড়ি খেয়ে পড়েন বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যকে অলৌকিক প্রমাণ করতে। বলার অপেক্ষা রাখে না, কোনো কোনো বই আবার মিলিয়ন মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে। অনূদিত হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায়। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের গুজব দাবানলের মতো করে। নাবিক, বৈমানিকদের মধ্যেও বাড়তি উন্মাদনা তৈরি করে সে রহস্য।

গত শতাব্দীর একের পর এক রহস্যময় ঘটনা ঘটতে থাকে শয়তানের ত্রিভুজ এলাকায়। তৈরি হয় কত গল্পগাথা। অবিশ্বাস্য সেসব কাহিনি, সেগুলোর পেছনের গল্প হরর বা রহস্যকাহিনিকেও হার মানাবে। কিছু কিছু কাহিনি যেন আসিমভ-সি ক্লার্কের কল্পবিজ্ঞান থেকে তুলে আনা।

গুজব ছড়ায় দিকে দিকে

তিন গোয়েন্দার কিশোর, মুসা ও রবিন মাঝেমধ্যে ব্যবহার করে ‘ভূত থেকে ভূতে,’ পদ্ধতি তথ্য ছড়ানোর জন্য। কোনো একটা তথ্য প্রথমে ১০ জন বন্ধুকে ফোন করে জানিয়ে দেয়। তথ্যের সঙ্গে এটাও বলে, এই তথ্য সে–ও যেন ফোন করে জানিয়ে দেয় ১০ বন্ধুকে। তাহলে ১ থেকে ১০, ১০ থেকে ১০০, ১০০ থেকে ১ হাজার! এভাবে ১০ মিনিটের মধ্যে গোটা রকি বিচে ছড়িয়ে পড়ে তিন গোয়েন্দার সেই তথ্য। অথচ মাইক বাজিয়েও এত সহজে গোটা শহরে তথ্যটা ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হতো না। কোনো গুজব জনসমাজে আসলে এভাবেই ছড়ায়। এক কান থেকে হাজার কান হতে সময় লাগে মাত্র কয়েক মিনিট। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যময় গল্পগুলো এভাবেই সত্তরের দশক থেকে আজ অবধি ছড়িয়ে যাচ্ছে ‘ভূত থেকে ভূতে’ পদ্ধতিতে। আগে বই, সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে ছড়াত, এখন ব্যবহৃত হচ্ছে ফেসবুক–ইউটিউবের মতো ভার্চ্যুয়াল মিডিয়া।

গুজবের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কিন্তু এত দ্রুত ছড়ায় না। নইলে অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে এসেও একদল লোক মনে করে, চাঁদে মানুষ যায়নি। ওটা ছিল হলিউডি পরিচালকদের বানানো উন্নত মানের চলচ্চিত্র। অথচ যেসব যুক্তির কথা বলে তারা এই গুজব ছড়িয়েছে, তার প্রতিটির ব্যাখ্যা সেকালেই দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। গুগল ইউটিউবে সার্চ করলেও পাওয়া যায় সেসব ব্যাখ্যা। তবু একদল হুজুগে মানুষ এটুকু কসরতের চেয়ে গুজবে বিশ্বাস করতেই ভালোবাসে। আবার ধরো, ফ্ল্যাট আর্থার সোসাইটির কথা। বিশ্বজুড়ে তাদের রয়েছে কোটি কোটি অনুসারী। তারা বিশ্বাস করে পৃথিবী সমতল। কিন্তু পৃথিবী যে সমতল নয়, সে প্রমাণ আড়াই হাজার বছর আগেই দিয়েছেন গ্রিক পণ্ডিতেরা। জিপিএস, স্যাটেলাইটের এই যুগে পৃথিবীকে সমতল হিসেবে বিশ্বাস করতেও আসলে প্রতিভা লাগে! একই কথা বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ঘটনাগুলো যতটা না রহস্যময়, তার চেয়ে বেশি গুজব! তাই বলে এত দুর্ঘটনার কাহিনিগুলো কি মিথ্যা?

মিথ্যা নয়, তবে সব কটির পেছনে যেমন কারণ আছে, আছে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও। তবে সে ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে গুজবগুলো একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর পুতুলনাচের ইতিকথায় বলেছিলেন, মানুষ ভয় পেতে ভালোবাসে। কথাটা সত্যি, মানুষ বৈজ্ঞানিক কারণ অনুসন্ধানের চেয়ে ভয় পাওয়াটাকেই বেশি রোমাঞ্চকর মনে করে। আর তাই ভয় পাওয়ার জন্য বেছে নেয় বিশেষ বিশেষ স্থানকে। এ দেশের ভয়খোর লোকেরা বুড়ো বট, তেঁতুলগাছ কিংবা বিশেষ কোনো জায়গাকে ভয় পাওয়ার স্থান হিসেবে বেছে নেয়। আন্তর্জাতিকভাবে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের অবস্থাটাও এ দেশের ওই বুড়ো বটগাছের মতো। বটগাছেও কিছু আপাত ব্যাখ্যাতীত ও কাকতালীয় ঘটনা ঘটে। সেগুলোকে ঘিরেই গড়ে ওঠে গুজবের ভিত।

বারমুডা ত্রিভুজকে ঘিরে সবচেয়ে জনপ্রিয় তত্ত্ব হলো অলৌকিক কোনো সত্তা এখানকার জাহাজ ও বিমানগুলো ডুবিয়ে দেয় কিংবা গায়েব করে দেয় ভোজবাজির মতো। অনেকের ধারণা, এটা শয়তান করে। খোদ গ্যাডিসই এমনটা দাবি করেছিলেন। তাই বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের অন্য নাম ডেভিলস ট্রায়াঙ্গল বা শয়তানের ত্রিভুজ।

তবে বারমুডা গুজবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়েছে বিজ্ঞানের হাইপোথিসিসগুলোসমান্তরাল মহাবিশ্ব, ওয়ার্মহোল, এলিয়েন ইত্যাদি। একশ্রেণির লোক বিশ্বাস করে, ওই ত্রিভুজাঞ্চলে এসে আস্তানা গেড়েছে ভিনগ্রহী প্রাণীরা। নিজেদের মতো করে সাগরের গভীরে বানিয়ে নিয়েছে এলিয়েন জগৎ। সেই জগতের সীমানায় কারও প্রবেশ তারা বরদাশত করবে কেন! তাই কোনো জাহাজ বা বিমান ওই এলাকার ভেতর একবার গিয়ে পড়লে আর রক্ষা নেই। এলিয়েনরা ধরে নিয়ে যায় তাদের জগতে! পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেয় জাহাজ বা বিমানের চিহ্ন।

আরেক দলের দাবি, ওই এলাকায় রয়েছে অদৃশ্য জগতের দরজা। সেটাকে কেউ ওয়ার্মহোল বলেন, কেউ বলেন সমান্তরাল মহাবিশ্বের দরজা। ওয়ার্মহোল হলো আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি থেকে আসা এক ভবিষ্যদ্বাণী। কাগজে-কলমে কিংবা গণিতের যুক্তিতেই শুধু এর প্রমাণ আছে। কিন্তু ওয়ার্মহোল তৈরি করা বা প্রাকৃতিক কোনো ওয়ার্মহোলের দেখা পাওয়ার মতো পর্যাপ্ত জ্ঞান এখনো মানুষ অর্জন করতে পারেনি। তাই এটা এখনো হাইপোথিসিস, ভবিষ্যতে কবে এই হাইপোথিসিস প্রমাণিত হবে কিংবা আদৌ প্রমাণিত হবে কি না, সে কথা এখনকার কোনো বিজ্ঞানীই জোর দিয়ে বলতে পারেন না। বারমুডা রহস্য নিয়ে যাঁরা অতিমাত্রায় কৌতূহলী, তাঁদের কারও কারও দাবি, শয়তানের ত্রিভুজের এলাকায় রয়েছে একটা ওয়ার্মহোল। সেটা অদৃশ্য। মাঝেমধ্যে দৃশ্যমান হয়, তখন জাহাজ বা বিমানগুলো খেই হারিয়ে ঢুকে পড়ে ওয়ার্মহোল নামের সেই রহস্যময় সুড়ঙ্গে। ওয়ার্মহোলের অন্য প্রান্তে থাকে ভিন্ন একটা সময়। সেটা হতে পারে কোটি কোটি বছর পেছনে কিংবা কোটি কোটি বছর ভবিষ্যতের কোনো সময়। সেই সুড়ঙ্গে কেউ ঢুকে পড়লে সে পৌঁছে যায় হয় অতীতে, না হয় ভবিষ্যতে। বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্বই আর থাকে না। তেমনি সেই সুড়ঙ্গের অন্য প্রান্তে থাকতে পারে ভিন্ন একটা জগৎ। যেটাকে আমরা প্যারালাল ইউনিভার্স বলি। বিমান বা জাহাজ একবার সেই জগতে ঢুকে পড়লে বেরোনোর উপায় নেই।

বারমুডা ত্রিভুজকে ঘিরে ওয়ার্মহোলের যোগসাজশের ঘটনা চাউর হয় মার্কিন বিমানচালক ব্রুস গার্নোনের কাছ থেকে। তাঁর দাবি, বারমুডা ট্রায়াঙ্গল পার হওয়ার সময় একবার তিনি প্রবল ঝড়ের মুখে পড়েন। ঝড় ও মুহুর্মুহু বজ্রপাতে তাঁর বিমানটি যখন ক্র্যাশ ল্যান্ডিংয়ের মুখে, তখনই ঘন মেঘের মধ্যে একটা সুড়ঙ্গের দেখা পান ব্রুক। বিমান চালিয়ে দেন সেটার ভেতর দিয়ে। তখন নাকি অলৌকিকভাবে বিমানের গতিবেগ বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণ। এ সময় তিনি কন্ট্রোল বেসের রাডারের সঙ্গেও যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেন। তাঁর দাবি অনুযায়ী, সুড়ঙ্গের ভেতর তিনি মোট ৩ মিনিটে ১৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছিলেন। মিনিটে ৫০ কিলোমিটার ২০২১ সালেও কোনো বিমানের জন্য স্বপ্ন। সেখানে ১৯৭০ সালে এ ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে দাবি ব্রুসের।

কেউ কেউ আবার আরেক কাঠি সরেস। আড়াই শতাব্দী আগে গ্রিক দার্শনিক প্লেটো বলেছিলেন, আটলান্টিক মহাসাগরের নিচে লুকিয়ে আছে আস্ত এক মহাদেশ। আটলান্টিস। বারমুডা-গুজবপ্রেমীদের অনেকের বিশ্বাস, শয়তানের ত্রিভুজের ঠিক নিচে রয়েছে আটলান্টিস। রহস্যময় আটলান্টিসেই হারিয়ে যায় জাহাজ আর বিমানগুলো।

বারমুডা রহস্য নিয়ে কতশত রিপোর্ট লেখা হয়েছে। ফেনিয়ে-ফাঁপিয়ে। গত শতাব্দীর আশির দশকে ইউরোপ-আমেরিকার ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলোর খ্যাতি ছিল চটকদার সংবাদ ছাপার জন্য। সত্যি হোক কিংবা মিথ্যা, বেশির ভাগ মানুষ সেগুলো বিশ্বাস করত চোখ বুজে। শুধু পত্রিকাই–বা বলি কেন, বইয়ের ভূমিকা কি কম? কোনো গুজবকে সত্যি প্রমাণ করার চেষ্টা করলে সে বইয়ের কাটতি বাড়ে বহুগুণ। বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে শত শত বই লেখা হয়েছে। সেগুলোর কিছু কিছু বিক্রি হয়েছে মিলিয়ন মিলিয়ন কপি। তৈরি হয়েছে সিনেমা, এমনকি টিভি সিরিজও। অর্থাৎ বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে সেকালে রমরমা এক ব্যবসা হয়েছিল। এ যুগেও থেমে নেই, ফেসবুক কিংবা ইউটিউবে খোঁজ করলেই বারমুডা রহস্যকে পুঁজি করে তৈরি হাজার হাজার পোস্ট কিংবা ভিডিওর খোঁজ মিলবে।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করেছেন অনেকেই, কেউ কেউ দিয়েছেন আজব সব থিওরি। যেমন কেউ বলেছেন, এখানে শয়তানের আস্তানা, শয়তান টেনে নিয়ে যায় এসব জাহাজ আর বিমান। কেউ বলেন, এখানে আসলে এলিয়েনদের বেসক্যাম্প আছে; এ জন্যই এখানে অদ্ভুত আলো দেখা যায়। এখানে ঢুকলে কম্পাস কখনো কখনো অদ্ভুত আচরণ কেন করে, সেটার পেছনে যুক্তি দেওয়া হয়েছে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের।

বিজ্ঞান কী বলে?

বিজ্ঞানে অমীমাংসিত রহস্যের ঠাঁই নেই। যতক্ষণ কোনো তত্ত্ব প্রমাণ না হচ্ছে, ততক্ষণ সেটা তত্ত্ব হিসেবে মর্যাদা পায় না। সেটাকে ধ্রুব সত্যি বলেও কোনো বিজ্ঞানী দাবি করবেন না। ওয়ার্মহোল তাত্ত্বিক বা গাণিতিকভাবে যতই যৌক্তিক হোক না, পৃথিবীর বুকে ওয়ার্মহোল তৈরি হবে, এ কথা স্বয়ং আইনস্টাইনকেও বিশ্বাস করানো যেত না। তিনি বেঁচে থাকলে বিশ্বাসও করতেন না এ যুগের কোনো বিমানের পক্ষে ১৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব। সুতরাং সবচেয়ে সহজ অঙ্ক এখানে ব্রুস সত্যি বলেননি। অথবা ওই সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনো কারণে।

এত এত মানুষ বলছে রহস্যের কথা, তার কি কোনো মূল্য নেই? আছে, তবে আসলেই যদি রহস্য হয়। গুজব রটনাকারীরা যত গুজব রটিয়েছে, গবেষকেরাও বারমুডা নিয়ে তত গবেষণা করেছেন। বিজ্ঞানীরা দুর্ঘটনার আরেকটি ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন। ট্রায়াঙ্গল এলাকায় প্রচুর মিথেন হাইড্রেড গ্যাসের উৎস আছে। সেসব উৎস থেকে বেরিয়ে আসা বুদ্‌বুদের ঝাঁক। লক্ষ–কোটি বুদ্‌বুদের কারণে কমে যায় পানির ঘনত্ব। পানির ঘনত্ব কমে যাওয়া মানেই জাহাজের জন্য সেটা দুঃসংবাদ। মুহূতের্র মধ্যে ডুবে যাবে অতি আধুনিক জাহাজও। এ কারণেই পানির অতি ঘনত্বের কারণে ডেড সিতে জাহাজ কেন, সাঁতার না জানা মানুষও অনায়াসে ভেসে থাকতে পারে।

তবে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল রহস্যের সবচেয়ে নিয়ামক মিডিয়া হিপোক্রেসি। আর পেছনে রয়েছে ব্যবসায়িক কারণ। আর্নেস্ট ট্যাভেস ও ব্যারি সিংগার দীর্ঘদিন পাখির চোখ রেখেছেন ওই অঞ্চলের ওপর। সঙ্গে শয়তানের ত্রিভুজ নিয়ে লেখা ট্যাবলয়েডের প্রবন্ধ ও বইপত্রের দিকেও রেখেছেন সতর্ক দৃষ্টি। বারমুডা ত্রিভুজ নিয়ে একশ্রেণির কলম ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত কৌশলে মিথ তৈরি করেছেন। তারপর কিছু দুর্ঘটনার সঙ্গে মিথগুলো মিশিয়ে, তাতে রং চড়িয়ে করেছেন বাণিজ্য। এসব কাহিনি পাঠক খায়, তাই ট্যাবলয়েডের সম্পাদক ও বইয়ের প্রকাশকদের পোয়াবারো!

তাই বলে সব লেখকই মিথ নিয়ে বাণিজ্য করেননি, কেউ কেউ রীতিমতো গবেষণা করে কলম দেগেছেন মিথ ব্যবসায়ীদের তথ্য-প্রমাণের অসারতা প্রমাণ করতে। মার্কিন লেখক ল্যারি কুশে তাঁদেরই একজন। ১৯৭৫ সালে তিনি বারমুডা রহস্যের মিথকে নাকচ করে দিয়ে লেখেন একটি বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণাত্মক বই দ্য বারমুডা ট্রায়াঙ্গল মিস্ট্রি: সলভড। বইয়ে তিনি তোপ দেগেছেন গ্যাডিসের বিরুদ্ধে, যিনি প্রথম বারমুডা ট্রায়াঙ্গল শব্দবন্ধের সঙ্গে এর মিথকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। শুধু গ্যাডিস নন, মিথের অন্য প্রচারকদের বিরুদ্ধেও একহাত নিয়েছিলেন কুশে। বলেছিলেন এসব লেখক সস্তা জনপ্রিয়তা আর টাকার লোভে অনেক ঘটনার অতিরঞ্জন করেছেন। কখনো ঘটেনি, এমন কাল্পনিক দুর্ঘটনার দায় চাপিয়ে দিয়েছেন বারমুডা ত্রিভুজের ওপর। আবার ত্রিভুজের বাইরে ঘটা অনেক ঘটনাকেই ত্রিভুজের নামে চাপিয়ে দিয়েছেন তাঁরা।

কুশে একটা হিসাব কষে দেখেছেন, আসলেই কতটা ভয়াবহ ওই ত্রিভুজ। তাঁরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সাগর-মহাসাগরের দুর্ঘটনার খতিয়ান ঘেঁটে দেখেছেন। সারা বিশ্বের গড় দুর্ঘটনার চেয়ে বারমুডা অঞ্চলে গড় দুর্ঘটনার পরিমাণ মোটেও বেশি নয়। বারমুডা নিয়ে হইচই বেশি হয় বলেই, ঘটনাগুলো রহস্যময় হয়ে ওঠে। আরেকটা ব্যাপারও কিন্তু অতিপ্রাকৃতিক রহস্যের ব্যাপারটাকে খারিজ করে দেয়। জাহাজ আর বিমান দুর্ঘটনার কথাই শোনা গেছে। ওখানে যদি সত্যিই রহস্যময় কিছু থাকে, সেগুলো হাপিস করে দেয় নৌযান আর বিমানকে, তাহলে অন্য যানবাহনগুলো কেন নয়। মজার ব্যাপার হলো, বারমুডা ট্রায়াঙ্গল অঞ্চলে অনেক ছোট–বড় দ্বীপ আছে। সেসব দ্বীপে দিব্যি মানুষ আর পশুপাখিরা বাস করছে। শয়তানের রোষ তাদের ওপর কেন পড়ছে না? অভিশাপ নিয়েও সেসব অঞ্চলে মানুষ দিনের পর দিন স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে! ওসব এলাকায় স্থলভাগের যেসব গণপরিবহন রয়েছে, সেগুলো কেন হাপিস হচ্ছে না! তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে, আদৌ রহস্যময় কিছু ওখানে নেই।

কুশের অভিযোগ ও বিশ্লেষণ যে ভিত্তিহীন নয়, তার প্রমাণ মেলে ফ্লাইট নাইন্টিনের ক্ষেত্রে। দুর্ঘটনা নিয়ে তদন্ত হয়েছিল। তদন্ত রিপোর্টে লেখা হয়েছিল, পাইলটদের ভুলের কারণেই ক্র্যাশ ল্যান্ডিং হয়েছিল। কিন্তু পাইলটের পরিবার এটা নিয়ে আপত্তি জানায়। মৃত স্বজনদের যেন ভিলেন না বানানো হয়, তার জন্য অনুরোধ করে। তদন্ত কমিশন তাঁদের অনুরোধ রক্ষা করে। রিপোর্ট সংশোধন করে দুর্ঘটনার কারণ ‘অজ্ঞাত’ লিখে দেয়। সে সংশোধিত রিপোর্ট পরে ছড়িয়ে পড়ে রহস্য হিসেবে।

তখন জিপিএস সিস্টেম ছিল না। একবার পথ হারালে, দিক ভুল করলে, সেটা সংশোধনের উপায় থাকত না। রাডার কম্পাসই তখন মূল হাতিয়ার। কোনো কারণে রাডার কম্পাস কাজ না করলে দিক খুঁজে পাওয়া কঠিন। তা ছাড়া ঝড়ের কবলে দিশা হারানোর পর পাইলট যদি মনে করেন তাঁর কম্পাস ঠিক দিক নির্দেশ করছে না, তাহলে বিপদ আরও ভয়াবহ রূপ নেবে। সেটাই হয়েছিল ফ্লাইট নাইন্টিনের ক্ষেত্রে। সবচেয়ে বড় সমস্যা, দিক ভুল করে বহু পথ উড়াল দিলে জ্বালানি ফুরিয়ে আসবে। তখন সঠিক দিক খুঁজে পেলেও কি রেহাই আছে? স্থল বা জলযানকে হয়তো থামিয়ে ফেলা যায় কিন্তু জ্বালানিহীন বিমানের ক্র্যাশ ল্যান্ডিং ছাড়া কোনো উপায় আছে?

 


শেয়ার করুন

Author:

A dedicated government professional with a passion for photography, book reading, and traveling. Holding a Bachelor of Social Science (BSS), I am also a professional graphics designer with extensive experience in the field. When I'm not working, I enjoy blogging to share my thoughts and experiences with a wider audience.