আর্নেস্তো গুয়েভারা ডেলা সেরনা। দুনিয়ার
মুক্তিকামী মানুষের উজ্জ্বল স্বাক্ষরে শুধুই পরিচিত নাম ‘চে’। জীবন জয়ের
সংগ্রামী ধ্রুবতারা, আর্নেস্তো চে গুয়েভারা। আর্নেস্তো গুয়েভারা লিঞ্চ ও
ডে লা সেরনার গর্ভের সন্তান। ১৯২৮ সালের ১৪ জুন পৃথিবীর আলোয় উদ্ভাসিত।
১৯৫২ সালে বুয়েন্স আয়ার্স থেকে ডাক্তার হয়েই পুরো লাতিন আমেরিকার সাধারণ
মানুষের জীবন-সংগ্রাম উপলদ্ধির জন্য পরিভ্রমণ। ১৯৫৪ সালে সিআইএ পরিচালিত
এক সামরিক অভিযানে গুয়াতেমালার জাকাবো আরবেনজের নির্বাচিত সরকারের উৎখাত
সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী। রাজনৈতিক কার্যকলাপের দায়ে মৃত্যু পরোয়ানা জারি।
গুয়াতেমালা ত্যাগ করে বাধ্য হয়ে মেক্সিকোতে আশ্রয় গ্রহণ করেন চে। কিউবার
স্বৈরতন্ত্রী সরকার ফুলজেনসিও বাতিস্তাকে ক্ষমতাচ্যুতের উদ্দেশে নির্বাসিত
কিউবার বিপ্লবীরা সেই সময়ে মেক্সিকোতে।
সেখানেই বিপ্লবীদের সাথে ঘনিষ্ঠতা এবং ফিদেল কাস্ত্রোর সান্নিধ্য লাভ। ১৯৫৫
সালের ২৫ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর সিয়েরা মায়েস্ত্রা পাহাড় থেকে কিউবার
বাতিস্তা সরকারকে উৎখাতের পরিকল্পনায় কিউবান বিপ্লবীদের সঙ্গী এবং
চিকিৎসক। ১৯৫৭ সালের জুলাইতে সশস্ত্র বিপ্লবী বাহিনীর প্রথম কমান্ডার। ১৯৫৯
সালে তীব্র সংগ্রামী লড়াইয়ে বাতিস্তা সরকারের পতন। চে তখন নতুন বিপ্লবী
সরকারের অন্যতম নেতা। এরপর জাতীয় ভূমি সংস্কার ও শিল্প দপ্তরের প্রধান।
জাতীয় ব্যাংকের সভাপতি, শিল্প দপ্তরের মন্ত্রী। ১৯৬৫ সালে কিউবার
কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা। সারা
পৃথিবীজুড়ে কিউবার প্রতিনিধিত্ব। আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও রাষ্ট্রপুঞ্জে
কিউবার প্রধান বক্তা। ১৯৬৫ সালের এপ্রিলে অন্যান্য দেশের মুক্তির সংগ্রামে
স্বশরীরে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে কিউবা ত্যাগ। কিছু সময় আফ্রিকার কঙ্গোতে
অবস্থান এবং পরে ফিদেল কাস্ত্রোর ব্যবস্থাপনায় গোপনে কিউবায়
প্রত্যাবর্তন। ১৯৬৬ সালের নভেম্বরে বলিভিয়ার নিপীড়িত মানুষের জীবনযুদ্ধে
ছদ্মবেশে বলিভিয়ায় প্রবেশ। কিউবান বিপ্লবী ও বলিভিয়ার নিপীড়িত মানুষদের
নিয়ে গেরিলা বাহিনী গঠন ও বলিভিয়ার সামরিক সরকারের উৎখাতের জন্য গেরিলা
অভিযান শুরু। একের পর এক সফল অভিযান। সারা বিশ্ব তখন আন্দোলিত। নিদারুণ
ঝঞ্চা বিক্ষুদ্ধ প্রতিকূল সময়ের এক বিরল যোদ্ধা ও সেনাপতি। ৮ অক্টোবর ১৯৬৭
সালে আমেরিকার বংশবদ প্রতিক্রিয়াশীল বলিভিয়ান সামরিক বাহিনীর হাতে আহত
এবং ৯ অক্টোবর ওয়াশিংটনের নির্দেশে সরাসরি গুলির আদেশে নিহত।
বিপ্লবের আইকন
১৯৬০ সালের ৫ মার্চ চে’র বিখ্যাত সেই ছবিটি তোলেন আলোকচিত্রী আলবের্তো
কোর্দা। ঠিক তার এক দিন পূর্বে হাভানা বন্দরে বোমা ও বিস্ফোরক বোঝাই একটি
ফরাসি মালবাহী জাহাজ বিস্ফোরিত হয়ে মারা যায় ৮০ জন কিউবান। তাদের
গণÑশেষকৃত্যানুষ্ঠানে যোগ দিতে সেদিন সেখানে গিয়েছিলেন চে। আর তখনই জ্বলে
ওঠে কোর্দার ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। ফ্রেমবন্দী হয় পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ
এই আলোকচিত্র। ছবিটি তোলার পরে অনেকদিন কোথাও প্রকাশিত হয়নি ছবিটি।
কোর্দার স্টুডিওতে যাঁরা আসা-যাওয়া করতেন তাঁদের চোখেই শুধু পড়েছে
দেয়ালে ঝুলে থাকা ক্রুদ্ধ, বিষণ্ন এক বিপ্লবীর মুখ। সাত বছর পর চে’র ছবিটি
দেখে আকৃষ্ট হন ইতালির বামপন্থী প্রকাশক ও বুদ্ধিজীবি গিয়াংগিয়াকোমো
ফেলত্রিনেলিঞ্চ। ইতালিতে ছবিটি নিয়ে আসেন তিনি। তাঁর মাধ্যমেই প্রথমে
পোস্টার আকারে ইউরোপে ছবিটি ছড়িয়ে পড়ে চে’র ছবি। শোষণ, বৈষম্য ও
পরিবর্তনের প্রতীক হয়ে ওঠে চে’র ছবি। চে গুয়েভারা নিজেই একটি ব্র্যান্ড।
এই ব্র্যান্ডের লোগো হচ্ছে চে’র বিপ্লবী জীবন যার অর্থ পরিবর্তন। আজ চে’র
ছবি যুদ্ধ ও বিশ্বায়নবিরোধী তথা পরিবেশবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
এক কিংবদন্তি বিপ্লবীর জন্ম
১৪ জুন ১৯২৮ সাল। আর্নেস্তো গুয়েভারা লিঞ্চ ও সেলিয়া ডে লা সেরনার ঘরে
জন্ম নিলো এক শিশু লাতিন আমেরিকার বিপ্লবী ইতিহাসের জ্বলজ্বলে এক নক্ষত্র।
জন্ম নিলো দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষের উজ্জ্বল স্বাক্ষরের পরিচিত একটি নাম
চে। আর্জেন্টিনার প্রথা অনুযায়ী বাবার নামানুসারে রাখা হলো তাঁর নাম
আর্নেস্তো গুয়েভারা।
রোজারিও ডি লা ফেতে নির্ধারিত সময়ের এক মাস আগে জন্ম নেওয়া নবজাতক পেল
আরও দুটি নাম : আর্নেস্তো এবং তেতে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য চে গুয়েভারার
শিরায় একই সঙ্গে বইছিলো আইরিশ ও স্পেনিস রক্ত। তাঁর মা সেলিয়া ছিলেন
স্পেনিয় এবং আমেরিকান রক্ত বইছে এমন এক অভিজাত জমিদার পরিবারের মেয়ে।
হাঁপানিও বিপ্লব থেকে টলাতে পারেনি চে’কে
চে গুয়েভারা হাঁপানিতে আক্রান্ত হন, হাঁপানি নিয়েই তাঁর পথ চলা। ১৯৩০
সালের ২ মে সুইমিং পুলের ঠাণ্ডা পানিতে দুই বছরের চে'কে গোসল করাতে গিয়েই
বাধে বিপত্তি। সেই প্রথম তাঁকে আক্রমণ করে হাঁপানি। তারপর আমৃত্যু তাঁর
পিছু ছাড়েনি হাঁপানি। মায়ের কাছে তাঁর শেখা প্রথম বুলির একটি ছিল
ইনজেকশন। ধারণা করা হয় চে গুয়েভারার লৌহ কঠিন মনোবলের পিছনে হাঁপানির
অবদান সবচেয়ে বেশি।
চে যখন খেলোয়াড়
বিপ্লবী জীবনের মতোই চে ছিলেন একজন ভালো খেলোয়াড়। রাগবি ছিলো তাঁর
পছন্দের খেলা। হাঁপানির কারণে মাঝে মাঝে মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছে তাঁকে।
দুর্দান্ত খেলার জন্য তাঁর নামই হয়ে যায় ‘ফিউসার’ (উন্মত্ত)। একবার
বাবা-মা তাঁকে জোর করে রাগবি ক্লাব থেকে বের করে আনলেন। কিন্তু
নাছোড়বান্দা চে গোপনে যোগ দিলেন আরেকটি ক্লাবে।
চে’র আরেক নেশা ছিলো দাবা। কিশোর বয়সেই এক প্রতিযোগিতায় আর্জেন্টিনার
বিখ্যাত দাবাড়– মিগুয়েল নাজদর্ফকে ড্রতে রুখে দিয়ে সবাইকে চমকে দেন। রুশ
দাবা চ্যাম্পিয়ন ভিক্টর করতচয়নের সঙ্গে কিউবার শিল্প মন্ত্রণালয়ে এক
দাবার আয়োজন করেছিলেন তিনি। ১৯৬৩ সালে টেলিফোনে কিংবদন্তির দাবাড়ু ববি
ফিশারের সঙ্গেও দাবা খেলেছেন চে।
লেখক যখন চে গুয়েভারা
বিপ্লবী এই মানুষটির লেখালেখির পরিমাণ জানলে অনেকেই চমকে উঠবেন। আমরা শুধু
তাঁর লেখা গোটা দশেক বইয়ের নাম জানি। এর বাইরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তাঁর অনেক লেখা। শুধু কিউবান ভাষায় তাঁর ৭০ টি নিবন্ধ
প্রকাশিত হয়। বেনামে, ছদ্মনামে লিখেছেন আরও ২৫ টি নিবন্ধ। পাঁচটির মতো
বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন।
১৯৫৮ থেকে ১৯৬৫ এই আট বছরে শুধু ভাষণ আর সাক্ষাৎকারই দিয়েছেন আড়াইশ’র
মতো। চিঠি পাওয়া গেছে ৭০ টি। তাঁর লেখালেখি নিয়ে এখন পর্যন্ত বের হয়েছে ৯
খণ্ডের রচনাবলি। এসবই তিনি করেছেন ৩৯ বছরের জীবনে, যার সিংহভাগই ব্যয়
হয়েছে বিপ্লবের আর ভ্রমণে।
চে’র বিখ্যাত চুরুট
সব সময় অতিরিক্ত ধুমপান করতেন চে। সহকর্মীরা তাঁর স্বাস্থ্য নিয়ে খুবই
দুশ্চিন্তা করতেন। শেষ পর্যন্ত একদিন তাঁদের দিকে চেয়ে আপস করলেন চে
গুয়েভারা; জানালেন, ‘আগামীকাল থেকে আমি কেবল একটা করে চুরুট খাবো।’ পরদিন
কথামতো একটা চুরুট নিয়েই হাজির হলেন তিনি। তবে সেই চুরুটের দৈর্ঘ্য ছিলো
প্রায় ১ মিটার।
কমিউনিস্ট থেকে ব্যাংকার চে
কিউবা বিপ্লবের পর, ক্ষমতা গ্রহণের পর চে গুয়েভারাকে প্রথম কিউবার
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করেন ফিদেল কাস্ত্রো। এই পদ গ্রহণ
নিয়ে আছে মজার এক ঘটনা। বিপ্লবীদের এক অধিবেশনে কাস্ত্রো জিজ্ঞেস করলেন,
‘এই কামরায় কি কোন ইকোনমিস্ট আছেন?’ ভুলে চে শুনলেন, ‘এখানে কি কোনো
কমিউনিস্ট আছেন?’ অতএব বিনা দ্বিধায় হাত তুললেন চে। কাস্ত্রো বললেন,
‘চমৎকার! আপনিই হবেন আমাদের ব্যাংক অব ন্যাশনালের প্রেসিডেন্ট।’ এভাবেই
ব্যাংকার বনে যান চে গুয়েভারা।
বোহেমিয়ান চে
বিপ্লবের পোড়া গন্ধ এসে নাকে লাগলো চে’র। ঘুরে দেখতে ইচ্ছা জাগলো সারা
লাতিন আমেরিকা। সঙ্গী ছোটবেলার বন্ধু আলবার্তো গ্রানাদোকে নিয়ে মোটর
সাইকেলে পুরো লাতিন আমেরিকা পাড়ি দেওয়ার পরিকল্পনা করলেন চে। পুরোনো একটা
মোটর সাইকেলের পিঠে চড়ে বেড়িয়ে পড়লেন দুই বন্ধু। চে’র বয়স তখন ২৩
বছর। চিলি পৌঁছুলেন আন্দিজ পর্বতমালা অতিক্রম করে। একপর্যায়ে গোড়া থেকেই
সমস্যা সৃষ্টি করতে থাকা মোটর বাইকটি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। অবৈধভাবে
বলিভিয়াগামী একটা মালবাহী জাহাজে চেপে বসলেন দু’জনে। এখানে বিশাল আয়তনের
খনি চুকুইকামাতা দেখার সুযোগ মিললো। উত্তর আমেরিকানদের পরিচালিত এই খনিতে
সাধারণ শ্রমিকদের বঞ্চণার চিত্র পরিষ্কার হয়ে উঠলো। অকুতোভয় চে এখান থেকে
রওনা হলেন পেরুর উদ্দেশে। একে একে পাড়ি দিলেন টিটাকাকা হ্রদ, কুজকো আর
মাচু পিচু। তারপর আমাজনের ভাটি ধরে চলে এলেন সান পাওলোর কুষ্ঠরোগীদের
কলোনিতে। এত বছর পরও সেখানকার কুষ্ঠরোগীরা স্মরণ করে অদ্ভুত দু’জন মানুষের
কথা, দস্তানা ছাড়াই যারা তাদের সঙ্গে করমর্দন করেছিলো, ফুটবল খেলেছিলো।
তাদের তৈরি করে দেওয়া ভেলায় চড়েই আমাজনের ভাটি ধরে যাত্রা অব্যাহত থাকলো
অভিযাত্রীদের। জুলাইয়ের শেষে একসঙ্গে সাত মাস ভ্রমণের পর কারাকাসে পৌঁছে
বিচ্ছিন্ন হলেন দু’জন। চে’র হাতে তখন মাত্র ১ ডলার।
‘মোটরসাইকেল ভ্রমণ’ খ্যাত এই সফর চে গুয়েভারার জন্য ছিলো খুবই
গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে লাতিন আমেরিকার সাধারণ মানুষের কাছাকাছি আসার এবং
তাদের দুঃখÑদুর্দশা অনুভবের সুযোগ পান চে। মাচু পিচুর ধ্বংসাবশেষ দেখার
সময় রেড ইন্ডিয়ানদের কষ্ট উপলব্ধি করে তিনি বলেছিলেন, ‘এই ভ্রমণের কারণে
আমি আবিস্কার করেছি দারিদ্র্য, পুষ্টিহীনতা আর প্রতিনিয়ত নিপীড়নের কারণে
যেসব শিশু অসুস্থ হয়ে পড়েছে তাদের সুস্থ করে তোলা এককথায় অসম্ভব।’
ফিদেলের সঙ্গে দেখা ও বিপ্লবী জীবনের আমন্ত্রণ
১৯৫৫ সালে এক কন্যা সন্তানের জনক হন চে গুয়েভারা। একই বছর জুলাইয়ের
দ্বিতীয় সপ্তাহে মেক্সিকোতে তাঁর সাথে দেখা হলো কিউবার দেশান্তরী বিপ্লবী
ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে। স্বৈরশাসক বাতিস্তাকে উচ্ছেদের জন্য কিউবায়
বিপ্লবীদের যে দলটা পাঠানোর পরিকল্পনা করছিলেন, তার জন্য একজন চিকিৎসক
খুঁজছিলেন ফিদেল। প্রস্তাবটা পাওয়ার পর সম্মতি জানাতে এক সেকেন্ডও দ্বিধা
করেননি চে। পরে এক চিঠিতে বাবাকে চে লিখেছেন, ‘এক তরুণ কিউবান নেতা তাঁর
দেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন আমাকে।
অবশ্যই আমি এটা গ্রহণ করেছি, আর এখন খুঁজে পেয়েছি আমার পথ।’ এই পথই তাঁকে
নিয়ে গেছে কিউবা থেকে কঙ্গো, কঙ্গো থেকে বলিভিয়া আর বলিভিয়া থেকে
অমরত্বের সাম্রাজ্যে।
গ্রানমা জাহাজ নিয়ে বিপ্লবের ডাক
প্রথমে ৮২ জন বিপ্লবীকে নিয়ে কিউবার লাস কালোরাডাস উপকূলে ভিড়ল ছোট্ট
কেবিন ক্রজার গ্রানমা। গ্রানমা থেকে নেমেই সুসজ্জিত এক সেনাদলের মুখোমুখি
হলেন চে। প্রথম ধাক্কাতেই অধিকাংশ সহযোদ্ধাকে হারালেন তিনি। বেঁচে যাওয়া
ডজন খানেক বিপ্লবী আশ্রয় নিলো ৮০ মাইল দীর্ঘ আর ৩১ মাইল প্রশস্ত সিয়েরা
মায়েস্ত্রা পর্বতমালায়। যেকোনো মুহূর্তে হত্যার জন্য অস্ত্র প্রস্তুত
রেখে স্থানীয় কৃষক আর সাধারণ মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে শুরু করলেন চে।
তাদের সঙ্গে নিয়ে আস্তে আস্তে দলের লোকসংখ্যা বাড়াতে লাগলেন চে। এভাবেই
প্রথম যুদ্ধের অভিজ্ঞতা অর্জন করলেন চে। পরে সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে
গিয়ে তিনি লেখেন, ‘আমার সঙ্গে ছিলো ওষুধভর্তি একটা থলে আর বুলেটপূর্ণ একটা
কেস। দুটো এক সঙ্গে বহন করা ছিলো আমার জন্য খুবই কষ্টকর। একসময় বুলেটের
কেসটা হাতে তুলে নিলাম, পেছনে পড়ে রইলো ওষুধের থলে।’
কিউবায় চে’র মিশন
২ জানুয়ারি ১৯৫৯ সাল। অবস্থা বেগতিক দেখে নতুন বছরের শুরুতেই দেশ ছেড়ে
সান্তো দমিনগো পালালো কিউবার প্রেসিডেন্ট বাতিস্তা। বিপ্লবী দলের কমান্ডার
চে গুয়েভারার নেতৃত্বে কিউবার রাজধানী হাভানায় প্রবেশ করলো বিপ্লবীরা।
অভূতপূর্ব আনন্দ উল্লাসের মধ্য দিয়ে তাদের বরণ করে নিলো গোটা কিউবার
আমজনতা। দীর্ঘায়িত হলো নতুন বছরের উদযাপনী উৎসব। কিউবা উপকূলে রক্তঝরানো
আর হতাশা জাগানো প্রবেশের পর ইতিমধ্যে পার হয়ে গেছে ২৫ টি মাস। চে’র বয়স
তখন ত্রিশ বছর।
আমজনতার সঙ্গে চে
১৪ মার্চ ১৯৬৫ সাল। কিউবার শুভেচ্ছাদূত হিসেবে আমেরিকা ও আফ্রিকা ভ্রমণ
শেষে কিউবায় ফিরলেন চে। বিমানবন্দরেই তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন ফিদেল
কাস্ত্রো। রুদ্ধদ্বার কক্ষে দীর্ঘ ৪০ ঘণ্টা বৈঠকে মিলিত হলেন দু’জন। আজও
মানুষ জানে না, সেদিন তাঁদের মধ্যে আসলে কী কথা হয়েছিলো। তার পরই অদৃশ্য
হয়ে গেলেন চে। গুজব ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে। আর্জেন্টিনা আর ভিয়েতনামে
তাঁকে দেখা গেছে এমন সংবাদও পাওয়া গেলো। মেক্সিকোয় রাজনৈতিক আশ্রয়
নেওয়ার খবরও শোনা গেলো। অন্যরা আবার বিশ্বাস করতে শুরু করলো যে, তিনি হয়
মারা গেছেন নয়তো হাভানা কারাগারে তিলে তিলে ক্ষয় হচ্ছেন। ২০ এপ্রিল
কাস্ত্রো সাংবাদিকদের জানালেন, ‘কমান্ডার চে গুয়েভারার ব্যাপারে আমি শুধু
এটুকু বলতে পারি, বিপ্লবের জন্য তাঁকে যেখানে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সব
সময় সেখানেই থাকেন তিনি।’
৩ অক্টোবর কাস্ত্রোকে লেখা চে’র একটি চিঠি প্রকাশ করলেন কাস্ত্রো। এপ্রিলের
তারিখ দেওয়া চিঠিতে চে লিখেছেন, ‘আমি মনে করি, কিউবায় আমি আমার দায়িত্ব
সঠিকভাবে পালন করেছি। অন্যান্য দেশও আমার আন্তরিক প্রচেষ্টার অপেক্ষায় পথ
চেয়ে আছে। কিউবার নেতা হওয়ার কারণে আপনি যা করতে অপারগ আমি তা করতে
পারি। আমাদের আলাদা পথে চলার সময় হয়েছে।’
একই সময় মা-বাবাকেও একটি চিঠি লেখেন চে, ‘আবার আমি পথে নেমেছি। অনেকেই
হয়তো অ্যাডভেঞ্চারার বলবে। আমি তা-ই, তবে একটা পার্থক্য আছে। আমি সেই
ধরনের, অ্যাডভেঞ্চারার, যে সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনের ঝুঁকি পর্যন্ত নিতে
পারে।’
কঙ্গোতে বিপ্লবের জন্মদান
১৯৬৫-১৯৬৬ সালে আফ্রিকায়ও বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিলো চে। এই
উদ্দেশেই গোপনে হাজির হলেন কঙ্গোয়। সেখানকার সাধারণ মানুষের কাছে তিনি
ছিলেন ত্রাণকর্তা, ওরা তাঁর নাম দিয়েছিলো মুগান্দা (ত্রাণকর্তা), আর
গেরিলাদের কাছে তিনি ছিলেন কমান্ডার ‘তাতু’। তখনকার সময়ে তাঁর সরল উক্তি,
‘আমি এমন এক সেনাদলের স্বপ্ন দেখি যারা কঙ্গোবাসীর জন্য বিজয় ছিনিয়ে
আনবে।’
এর ১১ মাস পর আফ্রিকান বিপ্লবীদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে পরিসমাপ্তি
ঘটে তাঁর স্বপ্নের। চে এই বিপ্লবীদের নাম দিয়েছিলেন ‘পর্যটক’, লড়াই করার
চেয়ে বড় বড় শহরগুলোয় আরাম-আয়েশ করেই দিন কাটানোই ছিলো যাদের পছন্দ।
এদিকে পর পর কয়বার আমাশয়, ম্যালেরিয়া আর হাঁপানির ভয়াবহ আক্রমণে চে’র
ওজন নেমে এল ৫০ কেজির নিচে। গোপনে কিউবায় ফেরার পূর্বে দার-ঊস-সালাম আর
প্রাগে চিকিৎসা নিলেন চে।
ফিদেল কাস্ত্রোকে লেখা চে’র শেষ চিঠি
ফিদেল,
এ মুহূর্তে অনেক কিছুই মনে পড়ছে আমার। মারিয়া অ্যান্তোনিয়র বাসায় যেদিন
আপনার সাথে দেখা হলো, যখন আপনি আহবান জানালেন বিপ্লবের প্রস্তুতির সাথে
জড়িত সকল উত্তেজনায় আমিও যেন অংশ নেই। একদিন কারা যেন জানতে চাইলো আমাদের
মৃত্যুর সংবাদ কাকে আগে অবহিত করতে হবে, এবং ঘটনাটার বাস্তবিক সম্ভাবনা
আমাদের সবাইকে বিচলিত করে তুললো। পরে আমরা জেনেছি বিপ্লবের ক্ষেত্রে
সবচেয়ে বড় সত্য হলো কেউ জিতবে নতুবা মৃত্যুবরণ করবে (যদি তা হয় প্রকৃত
বিপ্লব)।
এভাবেই বিজয়ের যাত্রাপথে শহীদ হন অগণিত কমরেড। সবকিছুতেই নাটকীয়তার সেই
স্বর আজ অনেক বেশি পরিণত। কিউবার বিপ্লবের প্রতি যে কর্তব্যবোধ আমাকে এর
সঙ্গে যুক্ত করেছিল, আমি অনুভব করছি, সে দায়িত্ব আমি সম্পন্ন করতে পেরেছি,
এবং আমি বিদায় জানাচ্ছি আপনাকে, কমরেডদের, আপনার জনগণকে যারা এখন আমারও।
আমি আনুষ্ঠানিকভাবে পার্টির নেতৃত্ব, মন্ত্রীর পদ, কমান্ডারের পদমর্যাদা
এবং কিউবার নাগরিকত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে আনছি। আইনগত আর কিছুই কিউবার
সঙ্গে আমাকে সম্পর্কযুক্ত করবে না। অবশিষ্ট যে বন্ধনটুকু থাকবে তা ভিন্ন
চরিত্রের, কোনোভাবেই তাকে ভেঙে ফেলা যায় না, যেকোনো নিয়োগচুক্তিকে খুব
সহজেই যেভাবে ভাঙা যায়। অতীতের দিকে তাকিয়ে আমি বিশ্বাস করি বৈপ্লবিক
বিজয়কে সুসংহত করার জন্য প্রয়োজনীয় সততা এবং যথাযথ নিষ্ঠা নিয়েই আমি
কাজ করেছি।
আমার একমাত্র ব্যর্থতা সিয়েরা মায়েস্ত্রার প্রথম সময়গুলোয় আপনার প্রতি
আমার আস্থার অভাব, এবং নেতা ও বিপ্লবী হিসেবে আপনার যোগ্যতাকে দ্রুত
উপলব্ধি করতে পারার অক্ষমতা। এখানে আমি দুর্দান্ত কিছু সময় কাটিয়েছি,
যুগপৎ দীপ্ত ও ক্যারিবীয় সংকটের ঝাপটায় বিমর্ষ দিনগুলোয় জনগণের সঙ্গী
হওয়ার গৌরবও অর্জন করতে পেরেছি। সেই সময়গুলোয় আপনার চেয়ে মণীষাপূর্ণ
নেতৃত্ব দেওয়া খুব কম রাষ্ট্রনায়কের পক্ষেই সম্ভব হতো। কোনো রকম দ্বিধা
ছাড়াই আমি যে আপনাকে অনুসরণ করেছি, আপনার ভাবার, দেখার এবং বিপদ ও নীতির
মূল্যবোধের প্রক্রিয়ার প্রতি আমি যে একাত্ম হতে পেরেছি, এ জন্য আমি
গর্ববোধ করি। পৃথিবীর অন্য জাতিগুলো আমার ঐকান্তিক সংগ্রামের পথ চেয়ে
আছে। তাদের ডাকেই আমি সাড়া দিচ্ছি, যদিও কিউবার রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার
কারণে এ কাজে অংশ নেওয়া আপনার পক্ষে এ মুহূর্তে সম্ভব নয়। আমাদের
বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় তাই এসে গেছে। এ কথা আমি জানাতে চাই, এই বিচ্ছেদ একই
সঙ্গে আমার জন্য আনন্দ ও বিষাদের। একজন নির্মাতা হিসেবে এই রাষ্ট্রের
প্রতি আমি রেখে যাচ্ছি আমার বিশুদ্ধতম প্রত্যাশা এবং আমার সবচেয়ে প্রিয়
মানুষের একজনকে, এবং এমন একজন মানুষকে যিনি আমাকে সন্তান হিসেবে গ্রহণ
করেছিলেন। এটা আমার আত্মার একটা অংশকে বিক্ষত করছে। নতুন যুদ্ধক্ষেত্রে আমি
সেই বিশ্বাসটুকুকেই সঙ্গী করে দাঁড়াবো যা আপনি আমার ভেতর বুনে দিয়েছেন,
সঙ্গে থাকবে পবিত্রতম কর্তব্য পালনের সুখানুভূতি; এই সবকিছু দিয়েই আমি
লড়বো সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, যেখানেই সে থাকুকনা কেনো। এ ব্যাপারটাই
আমাকে স্বস্তি দিচ্ছে আর শুশ্রুষা করছে অন্তরের গভীরতম ক্ষতকে।
আরেকবার বলতে চাই, সব রকমের দায়দায়িত্ব থেকে কিউবাকে মুক্ত করে দিচ্ছি
আমি, তবে এই রাষ্ট্রের উদাহরণ তার কাঁধে যে দায়িত্ব চাপাবে তা থেকে নয়।
যদি আমার শেষ মুহূর্তগুলো আমাকে আবিস্কার করে অন্যকোনো আকাশের নিচে, তবু
আমার শেষ ভাবনাগুলো এদেশের মানুষদের ঘিরেই থাকবে, বিশেষত আপনাকে। আমি আপনার
শিক্ষা এবং দৃষ্টান্তের জন্য আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ, এবং আমি আমার সংগ্রামের
চুড়ান্ত পরিণতি পর্যন্ত চেষ্টা করবো আপনার প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে। আমাদের
বিপ্লবেরর বিদেশনীতির প্রতি আমি সবসময় একাত্ম ছিলাম সামনেও থাকবো। যেখানেই
থাকি আমি, একজন কিউবান বিপ্লবীর কর্তব্যবোধ আমার মধ্যে থাকবে, এবং সে
অনুসারেই আমি কাজ করে যাবো।
এ বিষয়ে আমার তিলমাত্র লজ্জা নেই যে, আমার স্ত্রী এবং সন্তানদের জন্য
বৈষয়িক কোনো কিছুই রেখে যেতে পারলাম না; আমি সুখী এটাই সে রাস্তা। তাদের
জন্য অতিরিক্ত কিছুই আমি চাই না, কারণ জীবনধারণ আর শিক্ষা গ্রহণের জন্য
রাষ্ট্রই যথেষ্ট দেবে তাদের। আপনাকে এবং আমাদের জনগণকে অনেক কিছুই আমি বলতে
পারতাম, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তার কোনো প্রয়োজন নেই। শব্দের কাছে আমি যা
প্রত্যাশা করি তা প্রকাশের সামর্থ্য তার নেই, এবং এও আমার মনে হয় না যে,
লিখে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ভরিয়ে তোলার কোনো মানে আছে। আমার সমস্ত বিপ্লবী
স্পৃহা দিয়ে আপনাদের আলিঙ্গন করছি। -চে
(‘চে গুয়েভারা রিডার : রাইটিংস অন পলিটিক্স অ্যান্ড রেভ্যুলেশন’, অবলম্বনে ইংরেজি থেকে অনুদিত)
জীবনের শেষ বিপ্লব এবং অমরত্বের সন্ধানে
হাভানার শান্তিপূর্ণ জীবন আর ভালো লাগলো না চে’র কাছে। সিদ্ধান্ত নিয়ে
ফেললেন চে। এবার যেতে হবে বলিভিয়া। মার্কিন বংশবদ প্রতিক্রিয়াশীলদের হাত
থেকে ছিনিয়ে আনতে কাক্সিক্ষত বিজয়। কিউবান সিক্রেট সার্ভিসের সহযোগিতায়
ধূসর চুলের বছর চল্লিশের এক অভিজাত ভদ্রলোকের ছদ্মবেশ ধরলেন চে। মাথায় টাক
তৈরির জন্য চুল ফেলে দিলেন। নিজেকে খাটো দেখানোর জন্য জুতার হিল পুরোপুরি
ফেলে দিলেন। ঘন জঙ্গলের মতো ভ্রূ আর চোখে মোটা কাঁচের চশমা একেবারেই বদলে
দিলো চেহারা।
যাত্রা নিরাপদ করতে দুটি উরুগুয়ের পাসপোর্টেরও ব্যবস্থা হলো। ছদ্মবেশের
সাহায্যে শত্রুর চোখ ফাঁকি দিয়ে সহজেই বলিভিয়া ঢুকে পড়লেন চে। ১৮ জন
বিশ্বস্ত কিউবানসহ মাত্র ৫০ জন লোক নিয়ে প্রথম গেরিলা ঘাটি স্থাপন করলেন।
পুরনো একটি বাড়ির পাশে তৈরি হলো ক্যাম্প। গেরিলাদের খোঁড়া সুড়ঙ্গের
মধ্যে লুকিয়ে রাখা হলো খাবারদাবার আর অস্ত্র। আবহাওয়া প্রচণ্ড শুষ্ক। তার
ওপর পোকামাকড়ের কামড়ে রীতিমতো অতিষ্ট বিপ্লবীরা। তাঁরা আশা করেছিলেন
বলিভিয়ার কমিউনিস্ট পর্টির সহায়তা পাবেন। তারা তো তা করলই না, উল্টো চে’র
দলে যোগ দিতে দলীয় সদস্যদের নিষেধ করলো।
এদিকে দুই পরাশক্তির মধ্যে যে শান্তির সূচনা হয়েছে তা ক্ষতিগ্রস্থ করতে
নারাজ রাশিয়া। ফলে তড়াহুড়ো করে দলে লোক নিতে হয়েছে চে’কে। অল্প কিছুদিন
পরেই এদের অনেকে পালিয়ে যায়, কেউ বা বেঈমানি করে। মার্চের দিকে চে
অনুসন্ধান অভিযানে বাইরে থাকা অবস্থায় তাঁর ঘাটি দখল করে নিলো সেনাবাহিনী।
শুরু হলো সত্যিকার গেরিলা জীবন। দিন যত গড়াতে লাগলো ততই কোণঠাসা হয়ে
পড়তে লাগলো গেরিলারা। খাবার আর দরকারি ওষুধ পেতে পারেন হিগুয়েরায়, জানেন
চে। তাই যাত্রাপথে বলিভিয়ান কর্তৃপক্ষ বড় গুপ্ত আক্রমণের জন্য প্রস্তুত
হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। আশপাশের প্রতিটি এলাকায় প্রচুর সেনা মোতায়েন
করা আছে নিশ্চিত জেনেও দলের লোকদের ১৮ সেপ্টেম্বর লা হিগুয়েরার উদ্দেশে
মার্চ করার নির্দেশ দিলেন চে। শারীরিক ও মানসিক সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে
যাওয়া লোকগুলোকে দিয়ে এই চেষ্টা করা পাগলামি ছাড়া আর কিছুই না। প্রায়
পুরো পথটাই চলতে হবে লোক চলাচলের রাস্তা ধরে। ভীত কৃষক, স্থানীয় সরকারি
কর্মকর্তা আর বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট জেনারেল রেনে বারিয়েনতোজের ঘোষণা করা
৫০ হাজার পেসো পুরস্কার পাওয়ার জন্য উন্মুখ বাউন্টি হান্টারদের সামনে
দিয়ে যেতে হবে চে’র দলকে। গোড়া থেকেই সৃষ্টি হলো নানা বিশৃঙ্খলা।
জাগুয়ার দিকে চলে যাওয়া রাস্তা ধরে চলার সময় চোরাগুপ্তা হামলার শিকার
হলো চে’র দল। মারা গেলেন মিগুয়েল, কোকো এবং জুলিও। দল নিয়ে গ্রান্ড নদীর
দিকে যাওয়ার পথ ধরলেন চে।
অক্টোবরে প্রথম কয়েকটা দিন চে ১৬ জন বিপ্লবীর দল নিয়ে বেশির ভাগ সময়
কাটান লা হিগুয়েরার উত্তরের পর্বতগুলোর চূড়ায়। আর রাতগুলো তাদের কাটে
পর্বতগুলোর গুহায়। ৩ তারিখ রেডিওতে সহযোদ্ধা কেম্বা আর লিয়নের বন্দী
হওয়ার খবর প্রচার করা হলো। তাঁরা দু’জনই চে’র অসুস্থতা ও বিপ্লবী সবরকমের
গোপন পন্থা জানিয়ে দিলো সেনাবাহিনীকে। এ নিয়ে ডাইরিতে চে লিখেছেন,
‘এভাবেই সমাপ্তি ঘটলো বীরোচিত দু’জন গেরিলার।’ চে তাঁর দল নিয়ে লা
হিগুয়েরার একটি পর্বতে ক্যাম্প করলেন। ৮ অক্টোবর সকালে বলিভিয়ার
সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন গ্রে পেদ্রো আর তাঁর কোম্পানি এ এলাকার সবচেয়ে
দুর্গম গিরিসংকটগুলোর একটি কুয়েব্রাডা ডি ইউরোর মাথায় অবস্থান নিলো।
রাতের পথ চলা শেষে এখানেই বিশ্রাম নেওয়ার জন্য থেমেছে চে’র দল। রাতের
অন্ধকারে আবার যাত্রা শুরুর আগ পর্যন্ত এখানেই অবস্থানের পরিকল্পনা করেছে
চে। দুপুরের দিকে পেদ্রোর কোম্পানির একটা অংশ গেরিলাদের দেখে আক্রমণ করার
চেষ্টা করে। সংঘর্ষে দু’জন সৈন্য মারা যায়, আহত হয় বেশ কয়েকজন।
গেরিলাদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ছোট্ট এ দলটির দায়িত্বে থাকা
লেফটেন্যান্ট সাহায্যের জন্য রেডিওতে পেদ্রোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। দেরি না
করে বাকি সেনাদের নিয়ে গেরিলাদের অবস্থানের চারদিকে একটা বৃত্তের মতো তৈরি
করে এগোলেন পেদ্রো। এদিকে সেনাবাহিনীকে বিভ্রান্ত করে পালানোর জন্য ছোট
দলটাকে দু’টো অংশে ভাগ করলেন চে।
আর্নেস্তো চে গুয়েভারা’র নেতৃত্বে থাকা দলটি গিরিসংকট থেকে বের হওয়ার
সবচেয়ে কাছের পথটার দিকে রওয়ানা হলো। কিন্তু ইতিমধ্যে প্রচুর সেনাতে ভরে
গেছে রাস্তা। গেরিলারা সেনাদের গুলির নাগালের মধ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে
গুলিবৃষ্টির মুখে পড়তে হলো চে’র দলকে। ফিল্ডগ্লাসে গেরিলাদের আড়ালের
খোঁজে দৌঁড়াতে দেখলেন পেদ্রো। সার্জেন্ট বার্নাডিনো হুয়ানকাকে দল নিয়ে
গেরিলাদের অনুসরণ করে নিচে নেমে আসার নির্দেশ দিলেন পেদ্রো। কয়েক মিনিট পর
ঘন ঝোপের আড়াল দিয়ে এগোতে থাকা এক গেরিলার দিকে সাবমেশিনগান ফায়ার
করলেন হুয়ানকা। একটা গুলি চে’র মাথার টুপি উড়িয়ে দিলো। অপর দু’টো গুলি
তাঁর পায়ে বিদ্ধ হলো, মাটিতে পড়ে গেলেন চে। রেঞ্জাররা জায়গাটাকে লক্ষ্য
করে গুলি করতে শুরু করলো। উইলি (সাইমন কিউবা) নামের এক গেরিলা দৌঁড়ে এসে
চে’কে গুলির লাইন থেকে সরিয়ে গিরিসংকটের এক পাশে আশ্রয় নিতে সাহায্য
করলেন। গুটিসুটি মেরে ওপর দিকে উঠছেন এমন সময় কামান দাগার মুখে পড়লেন
চে’র দল। তাঁদের আত্মসমর্পণ করতে বললো রেঞ্জাররা। প্রত্যুত্তরে একটা গাছের
সঙ্গে শরীর মিলিয়ে দাঁড়িয়ে সেনাদের লক্ষ্য করে কারবাইন থেকে গুলি
ছুঁড়তে শুরু করলেন চে। কয়েক সেকেন্ড পরেই কারবাইনের ব্যারেলে আঘাত হানা
একটা গুলি এটাকে নিস্ক্রিয় করে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে দুই হাত ওপরে তুলে জোরে
চিৎকার করে উঠলেন চে, ‘গুলি করো না। আমি চে গুয়েভারা। তোমাদের কাছে মৃত
আমার চেয়ে জীবিত আমার মূল্য অনেক বেশি।’ কয়েক গজ দূরে উইলিও তাঁর রাইফেল
ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করলেন।
রেডিওতে উর্দ্ধতন সামরিক কর্মকর্তা কর্নেল জেনটেনোর নির্দেশ পেয়ে দুই
বন্দীসহ লা হিগুয়েরার উদ্দেশ্যে রওনা হলো রেঞ্জাররা। একটা কম্বলে চে’র আহত
দেহ মুড়িয়ে বহন করছে চার সেনা। লা হিগুয়েরা পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে এলো।
কিছু সময় পরে মাটির একটি স্কুলের স্যাতস্যাতে একটি কামরায় হাত-পা বেঁধে
রাখা হলো চে গুয়েভারাকে। তাঁর সামনেই পড়ে আছে আন্তোনিও আর আর্তারার
মৃতদেহ। অন্য একটি কামরায় রাখা হয়েছে অক্ষত উইলিকে। এদিকে এনতি পেরোদার
নেতৃত্বে গেরিলাদের অপর দলটি সেদিন রাতে গিরিসংকটের ফাঁদ থেকে বের হয়ে এল।
পরের কয়েক সপ্তাহে গেরিলাদের এই দ্বিতীয় দলটি ধরা পড়ে সেনাদের হাতে।
বেঁচে যায় যারা তাদের মধ্যে অবশিষ্ট তিন কিউবান পমবো, বেনিগানো ও আরবানো
চিলি হয়ে দেশে পালিয়ে যেতে সমর্থ হন। তিন বলিভিয়ান ইনতি, দায়রো আর নেতো
গা ঢাকা দেন।
৮ অক্টোবর রাতে এবং ৯ অক্টোবর সকালে মেজর আয়োরা, কর্নেল আদ্রে সেলিচ ও
ক্যাপ্টেন পেদ্রোসহ বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা চে’কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
গেরিলাদের সম্পর্কে কোন তথ্য ফাঁস না করলেও সেনা কর্মকর্তাদের সাথে উত্তপ্ত
কয়েকটি বাক্যবিনিময় করেন চে। একসময় তরুণ এক সেনা কর্মকর্তা জিজ্ঞেস করে
তিনি কি ভাবছেন। শুরুতে জবাব না দিলেও সেনা কর্মকর্তাটি যখন বললেন তিনি
সম্ভবত নিজের অমরত্বের কথা ভাবছেন। তখন চে বললেন, ‘আমি বিপ্লবের অমরত্বের
কথা ভাবছি।’
চে’কে ধরার আনন্দে বেশি এ্যালকোহল নেওয়া এক তরুণ কর্মকর্তা বারবার তাঁকে
আঘাত করার চেষ্টা করছিলো। ওই অবস্থাতেই তার মুখে লাথি মেরে জবাব দিলেন চে।
সেলিচ যখন চে’কে জিজ্ঞেস করলেন বলিভিয়াকে কেন বেছে নিলেন। তখন চে এখানকার
কৃষকদের দারিদ্র আর মানবেতর জীবনকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করলেন। তিনি কিউবান
না আর্জেন্টাইন এটা জানতে চাইলে বললেন, ‘কিউবান, আর্জেন্টাইন, বলিভিয়ান,
পেরুভিয়ান, ইকুয়েডরিয়ান ইত্যাদি... বুঝতে পারছো আশা করি।’
এদিকে রাজধানী লা পাজে প্রেসিডেন্ট বেরিয়েনতোস এবং উচ্চপর্যায়ের
কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্র ও সিআইএর সবুজ সংকেত পাওয়ার পর সিদ্ধান্তে
পৌঁছলেন, চে’কে কোনো অবস্থাতেই স্বাভাবিক বিচারের মুখোমুখি করা যাবে না,
কারণ এতে বিশ্বব্যাপী তাঁর পক্ষে জনমত সৃষ্টির সম্ভাবনা প্রবল। সেনা
কর্মকর্তারা ঠিক করলেন, দেরি না করে দ্রুত চে’র প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হবে
এবং সরকারিভাবে জানানো হবে, যুদ্ধের সময় পাওয়া আঘাতে মারা গেছেন চে।
সোমবার ৯ অক্টোবর সকালে ওয়াশিংটন থেকে চে’কে হত্যার নির্দেশ পেলেন লা
হিগুয়েরার কর্মকর্তারা। তাদের আরও বলা হলো ননকমিশন্ড কোন কর্মকর্তা যেন
কাজটা করেন।
৯ অক্টোবর দুপুরের একটু আগে কুয়েবার্ডা ডি ইউরোতে চে ও তাঁর সঙ্গীদের
আবিস্কার করার ২৪ ঘন্টা পরে বলিভিয়ান সরকারের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের
নির্দেশ পালন করতে ছোট্ট স্কুল ঘরটার দিকে রওনা হলেন সার্জেন্ট টেরান।
কামরাটায় ঢুকে দেখলেন একপাশের দেয়ালে ঠেস দিয়ে অপেক্ষা করছেন চে।
টেরানের আসার কারণ অনুমান করতে পেরেছিলেন চে। উঠে দাঁড়ানো পর্যন্ত টেরানকে
অপেক্ষা করতে বললেন। এ সময় টেরান এত ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন যে, কাঁপতে
কাঁপতে এক পর্যায়ে স্কুল থেকে বের হয়ে যান। কিন্তু কর্নেল সেলিচ আর
জেনটেনোর নির্দেশে আবার চে’র কামরায় ফিরে আসতে হলো টেরানকে। এবার একবারও
বন্দির মুখের দিকে না তাকিয়ে তাঁকে লক্ষ্য করে কারবাইন থেকে গুলি ছুঁড়তে
শুরু করলেন। হাত ও পায়ে গুলি লেগে মাটিতে পড়ে যাওয়া চে কষ্ট চাপা
দেওয়ার জন্য নিজের হাত কামড়ে ধরলেন। এসময় আবার গুলি করা শুরু করলো
টেরান। ঘাতক বুলেট প্রবেশ করলো চে’র বুকে। ফুসফুস রক্তে রঞ্জিত হলো।
১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর মাত্র ৩৯ বছর বয়সে চির বিদায় নিলেন বিপ্লবের
বরপুত্র আর্নেস্তো চে গুয়েভারা। মৃত্যুর পর ক্ষতবিক্ষত চে’র দেহ
ভ্যালেগ্রান্দেতে নিয়ে যাওয়া হয় হেলিকপ্টারে করে; সেখান থেকে শেভ্রোলে
ট্রাকে করে দ্রুত সেন ডি মাল্টা হাসপাতালে। এখানেই তাঁর দেহ থেকে ধুয়েমুছে
রক্ত পরিস্কার করা হয়। তারপর বলিভিয়ার সেনাপ্রধান জেনারেল আলফ্রেদো
ওবান্দোসহ অন্য সামরিক কর্মকর্তারা নিহত চে’কে দেখতে আসেন। ডাক্তার ও
সরকারি কর্মকর্তাদের কাজের শেষে সাংবাদিক, কৃষক আর সাধারণ মানুষ সারা রাত
লাইন দিয়ে চে’কে দেখে যায়। তাঁর জ্যাকেটবিহীন খোলা দেহ, কোমর থেকে নিচ
পর্যন্ত গেরিলা প্যান্ট। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, চে তখন
আশ্চর্যজনকভাবে জীবন্ত ছিলেন। চোখ দুটি শুধু খোলাই ছিলো না, অসম্ভব রকম
সুন্দর লাগছিলো। দুটি ঠোঁটে লেগেছিলো বিপ্লবের হাসি। চে’র এই ছবিটি
যিশুখ্রিস্টের মতো ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। যে ছবি যিশুখ্রিস্টকেও হার
মানিয়ে দিয়েছে কয়েকযুগ আগে।
এভাবেই চে’র দেহ ২৪ ঘন্টা রেখে দেওয়া হয়েছিলো। বিস্ময়ে আর সম্মানে তাঁকে
দেখে যাচ্ছিলো মানুষ আর মানুষ। এরপর বলিভিয়া কর্তৃপক্ষ চে’র মৃত্যুর
প্রমাণ রাখার জন্য তাঁর দুই হাত কেটে এবং প্লাস্টারে মুখের ছাপ নিয়ে
সঙ্গীদের সাথে চে’কে কবর দিয়ে তা গোপন রাখা হয়। তাঁর মৃত্যুর এক বছরের
মধ্যে ১৯৬৮ সালের মার্চে প্রথম জীবনে কমিউনিস্ট পরে সিআইএ এজেন্ট ও
বলিভিয়ার সরাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তোনিও আরগুয়েডেস গোপনে এক সাংবাদিক বন্ধুর
মাধ্যমে চে’র বলিভিয়ার ডায়েরির ফটোকপি কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রোর কাছে
উপহার হিসেবে পাঠান। হাতে পাওয়ার পরেই কিউবা সরকার চে’র ডায়েরি প্রকাশ
করে যার নাম ‘বলিভিয়ার ডায়েরি’। দ্রুত এই বই কিউবা থেকে লাতিন আমেরিকা,
ইউরোপ ও সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আরগুয়েডেস রাসায়নিক উপাদানে সংরক্ষিত
চে’র দুই হাত লেখক বন্ধু জর্জ সুয়ারেজের হাতে তুলে দেন চে’র মৃত্যুর আট
দিন পরে। কিন্তু নানা ঘটনায় এগুলো কিউবায় পৌঁছাতে দুই বছরের বেশি সময়
লাগে। ১৯৭০ সালের জানুয়ারি তা কিউবায় পৌঁছায়। এদিকে ১৯৯৭ সালের জুলাইয়ে
কিউবা ও আর্জেন্টিনার ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা ভ্যালেগ্রান্দেতে হাতবিহীন চে ও
তাঁর সঙ্গীদের দেহাবশেষ খুঁজে পান। সেসব দেহাবশেষ কিউবায় পাঠানো হলে
কিউবার সান্তা ক্লারায় নতুন স্মৃতিসৌধ স্থাপন করে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
যা আজ বিপ্লবের পবিত্রতম স্থান বলে বিবেচিত।
অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে সারা বিশ্বে চে এখন অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক,
অনেক বেশি জাগ্রত। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে, প্রতিবাদে ও সংগ্রামের
রক্তধারায় মিশে আছেন চে। মানুষের জাগরণে অনুপ্রেরণা, প্রণোদনা হয়ে
প্রতিদিনের সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। শুধু লাতিন আমেরিকা নয়, সারা
বিশ্বের নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের বিপ্লব, বিদ্রোহ ও উত্থানের আরও
শক্তিশালী সহযাত্রী হয়ে ফিরে এসেছেন আর্নেস্তো চে গুয়েভারা।
শেয়ার করুন
1 coment rios:
nice---------------
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন