রবিবার, ৩১ জুলাই, ২০১৬

সবুজ ময়ূর

বুজ ময়ূর (Pavo muticus) (ইংরাজি: Green Peafowl) বা বর্মী ময়ূর Phasianidae (ফ্যাসিয়ানিডি) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত Pavo (পাভো) গণের অসাধারণ সুন্দর, ঝলমলে রাজকীয় ময়ূর। সবুজ ময়ূরের বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ ছোট ময়ূর (ল্যাটিন: pavo = ময়ূর; muticus = ছোট, ক্ষুদে বা সংক্ষিপ্ত)। সারা পৃথিবীতে এক বিশাল এলাকা জুড়ে এদের আবাস, প্রায় ৯ লাখ ৯১ হাজার বর্গ কিলোমিটার। আবাসস্থল এত বিশাল হলেও পুরো এলাকাটির মাত্র অল্পসংখ্যক এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে এদের বিস্তৃতি রয়েছে। আবার বিগত কয়েক দশকে এদের সংখ্যা ভয়াবহভাবে হ্রাস পেয়েছে। সেকারণে আই ইউ সি এন এই প্রজাতিটিকে Endengered

সবুজ ময়ুর

বা বিপন্ন বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে একসময় এরা প্রচুর পরিমাণে থাকলেও সম্প্রতি এদের দেখতে পাওয়ার কোন সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ নেই। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।
সমগ্র পৃথিবীতে আনুমানিক ১০ হাজার থেকে ১৯ হাজার ৯৯৯টি পূর্ণবয়স্ক সবুজ ময়ূর রয়েছে। অপ্রাপ্তবয়স্ক-প্রাপ্তবয়স্ক সব মিলিয়ে মোট সবুজ ময়ূরের সংখ্যা আনুমানিক ১৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার।


বিস্তৃতি
এক সময় সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশ জুড়ে সবুজ ময়ূরের অবাধ বিস্তার ছিল। বর্তমানে জীবিত ময়ূরের বড় অংশ কম্বোডিয়া, মিয়ানমারও ভিয়েতনামের পশ্চিমাংশে বসবাস করে। বাকি সবুজ ময়ূরের বসবাস উত্তর ও পশ্চিম থাইল্যান্ড, দক্ষিণ লাওস, চীনের হিনান প্রদেশ ও ইন্দোনেশিয়ার জাভায়। ভারতের মনিপুর প্রদেশে কদাচিৎ এদের দেখা মেলে। একসময় মিজোরামে এদের স্থায়ী আবাস হলেও এখন আর সেখানে এদের দেখা যায় না। সর্বশেষ ২০০৭ সালে মিজোরামের দক্ষিণে একটি সবুজ ময়ূর দেখা গিয়েছিল। বাংলাদেশে ১৯৪০ এর দশকেও সবুজ ময়ূর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা ছিল। এখনও বান্দরবানের গহীন বনে সবুজ ময়ূর থাকতে পারে। মালয়েশিয়া থেকে বহু আগেই এরা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।


উপপ্রজাতি
এ পর্যন্ত সবুজ ময়ূরের মোট তিনটি উপপ্রজাতি সনাক্ত করা গেছে।উপপ্রজাতিগুলো হচ্ছে:
  • P. m. spicifer (Shaw & Nodder, 1804) – উত্তর-পূর্ব ভারত, বাংলাদেশ এবং উত্তর-পশ্চিম মিয়ানমারে এদের সহজেই দেখা মিলত। এই উপপ্রজাতিটি সম্ভবত বিলুপ্ত (Possibly extinct)। উপপ্রজাতিটিতে নীলের ভাগ বেশি ও উজ্জ্বলতা বেশ কম।
  • P. m.imperator (Delacour, 1949) – মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও চীনে এদের দেখা যায়। P. m.imperator প্রায় muticusএর মতই, তবে দেহতল বেশি গাঢ় ও চোখের পাশের হলুদ ছোপটি কম উজ্জ্বল।
  • P. m. muticus (Linnaeus, 1758) – কেবলমাত্র ইন্দোনেশিয়ার জাভায় দেখা যায়। একসময় মালয় উপদ্বীপে বিস্তৃত থাকলেও সে এলাকায় এরা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। উপপ্রজাতিগুলোর মধ্যে এই উপপ্রজাতিটি সবচেয়ে উজ্জ্বল সবুজ আর এর ডানার পালকে গাঢ় সবুজ ও নীল বর্ণ থাকে।




বিবরণ
সবুজ ময়ূর দেখতে অনেকটা নীল ময়ুরের মতই, তবে শরীরে ঝলমলে ধাতব সবুজ পালকের আধিক্য রয়েছে। এরা বেশ বড় আকারের ভূচর পাখি। এদের দৈর্ঘ্য ১০০-৩০০ সেন্টিমিটার, ডানা ৪৫ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ৪.ত সেন্টিমিটার, পা ১৫.২ সেন্টিমিটার, লেজ ৪.৩ সেন্টিমিটার এবং ওজন ৪.৫ কিলোগ্রাম। পুরুষ ময়ূরের পেখম ১৫০ সেন্টিমিটার।পুরুষ ময়ূরের চেহারা ও আকার স্ত্রী পাখির থেকে কিছুটা আলাদা। পুরুষ ময়ূরের পিঠ ও ঘাড় সবুজ; ঘাড়, গলা ও বুকের পালক আঁশের মত উঁচু। পালকহীন মুখের চামড়া নীল ও হলুদে মেশানো। ডানা-ঢাকনি সবুজ রঙের। ডানার মধ্যভাগ ও গোড়ার পালক বাদামি; লেজের পেখমের প্রান্তে কালো চক্রের মধ্যে বেগুনী ফোঁটা দেখা যায়। দেহতলে সরু কালো ধাতব তামাটে, সবুজ ও বেগুনী দাগ থাকে। এমনিতে স্ত্রী ময়ূর বা ময়ূরীর চেহারা সামনে থেকে পুরুষ ময়ূরের মতই, তবে দেহের কিছু কিছু অংশ ফ্যাকাসে। পিঠ গাঢ় বাদামি বর্ণের। লেজ পেখমহীন। ডানা-ঢাকনি, পিঠের শেষভাগ ও কোমর কালচে বাদামি। লেজে পীতাভ, বাদামি ও কালো রঙের ডোরা আছে। স্ত্রী ও পুরুষ উভয় ময়ূরের সুঁচালো ও বিপরীতমুখী। চোখ কালো, পা ও ঠোঁট ধূসর। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি দেখতে ময়ূরীর মত, কেবল কোমরে সবুজাভ ও তামাটে বর্ণ থাকে না।
স্বভাব
সবজ ময়ূর সাধারণত ছোট দলে বিচরণ করে; এক একটি দলে একটিমাত্র পুরুষ ময়ূর ও তিন থেকে পাঁচটি ময়ূরী থাকে। এরা স্বভাবে দিবাচর, তবে ভোরবেলা আর গোধূলিতে বেশি সক্রিয় থাকে। জোরে ডানা ঝাপটে এরা দ্রুত উড়তে পারে। ময়ূর উঁচুস্বরে ইয়েই-অও….. স্বরে ডাকে যা বহু দূর থেকেও শোনা যায়। ময়ূরীর ডাক অনেকটাঅ্যাও-অ্যা….। ভয় পেলে এরা ডাকে কের্-র-র-র-রু….। এক ময়ূরের ডাকের জবাবে অন্য ময়ূরও ডেকে ওঠে। বেশিরভাগ এলাকাতেই এরা লাজুক স্বভাবের এবং কাছে গেলেই লুকিয়ে পড়ে বা উড়ে যায়। তবে যেসব এলাকায় এদের তেমন একটা ক্ষতি করা হয় না, সেসব এলাকায় এরা মানুষের আশেপাশে পোষা পাখির মত ঘুরে বেড়ায়।
বিচরণস্থল
সবুজ ময়ূরের বিচরণ সমূদ্রসমতল থেকে সর্বোচ্চ ৩০০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত হয়। সবুজ ময়ূর প্রধানত হালকা বনভূমি, বনভূমি সংলগ্ন ঘাসবন ও খোলা জায়গা, সাভানা, বনসংলগ্ন নদীর পাড়, ক্ষেতখামার ইত্যাদি এলাকায় খাবারের খোঁজে ঘুরে বেড়ায়। অনেকসময় গৃহপালিত হাঁস-মুরগীর সাথে ঘুরে ঘুরে খাবার খায়। এদের জীবনধারণের জন্য প্রচুর পানির দরকার হয়, সেকারণে পানির উৎসের আশেপাশেই এদের দেখা যায়।
খাদ্যাভ্যাস
এদের জাতভাই নীল ময়ূরের মত সবুজ ময়ূরও সর্বভূক। খাদ্যতালিকায় রয়েছে বীজ, শস্যদানা (মূলত ধান), তৃণ, কচি উদ্ভিদের কান্ড, গাছের পাতা, ফুলের কলি, রসালো ফল ইত্যাদি। এছাড়া এরা ঘাসফড়িং, গুবরে পোকা, মথ, ফড়িং, ঝিঁঝিঁ পোকাসহ বিভিন্ন জাতের পোকামাকড়, ব্যাঙ, গিরগিটি ও ছোট সাপ খায়। মটরশুঁটি আর মিষ্টি আলুর মৌসুমে এরা ক্ষেতে হানা দিয়ে ফসল সাবাড় করে। মাটি আঁচড়ে, ঝরা-পাতা উল্টে এরা বনতলে খাবার খুঁজে বেড়ায়।
প্রজনন
যদিও একটি ময়ূরকে ঘিরে একাধিক ময়ূরী নিয়ে একটি দল তৈরি করার ব্যাপারটা জানা যায়, তবুও দলগুলো স্থায়ী হয় না। প্রকৃতপক্ষে ময়ূর তার এলাকায় অনুপ্রবেশকারী একটি ময়ূরীর (কখনও কখনও একাধিক, তবে এমনটি কমই ঘটে) সাথে জোড়া বাঁধে। আর বাকি ‘ময়ূরীরা’ আসলে অপ্রাপ্তবয়স্ক ময়ূর যারা ঐ ময়ূরীর সন্তানমাত্র। আবদ্ধ অবস্থায় সবুজ ময়ূরের একগামী স্বভাবের মাধ্যমে একথার সত্যতা মেলে। নীল ময়ূরের সাথে সবুজ ময়ূরের এটি আর একটি পার্থক্য।
জানুয়ারি থেকে মে এদের প্রধান প্রজননকাল। প্রজননকালে পুরুষ ময়ূরেরা কঠিনভাবে তাদের নিজ নিজ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিটি ময়ূর তার প্রতিবেশী ময়ূরের থেকে ১০০ থেকে ৪০০ মিটারের মত দূরত্ব বজায় রাখে। এসময় এরা পেখম মেলে ও ধীরে ধীরে ঘুরে ঘুরে ময়ূরীর দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করে। ময়ূরী একাই বাসা বানাবার জন্য জায়গা নির্ধারণ করে এবং ঘন ঝোপের নিচে মাটিতে বাসা করে। বাসা বানানো শেষে ৩-৮টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলোর বর্ণ পীতাভ। ডিমগুলোর মাপ ৭.২ × ৫.৩ সেন্টিমিটার। কেবল স্ত্রী ময়ূর ডিমে তা দেয়। ২৬-২৮ দিন পর ডিম ফুটে ছানা বের হয়। ছানারা খুব কম বয়সেই উড়তে শিখে যায়। অপ্রাপ্তবয়স্করা মায়ের সাথে ঘুরে বেড়ায়। সাধারণত ময়ূর দুই বছরে এবং ময়ূরী এক বছরে বয়োঃপ্রাপ্ত হয়।
অস্তিত্বের সংকট
সবুজ ময়ূর খুব সরব পাখি। একটু শব্দ হলে বা বিশ্রামের সময়ে এরা ডেকে ওঠে। ফলে এরা শিকারীর সহজ শিকারে পরিণত হয়। আবার বড়সড় আকার ও ঝলমলে পালকের জন্য এরা খুব সহজেই দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়। নির্বিচারে শিকারের ফলে দিন দিন এরা সংখ্যায় কমে যাচ্ছে। এছাড়া বেআইনী ব্যবসা, আবাসস্থল ধ্বংস, বিচ্ছিন্ন বিস্তৃতি, অপরিকল্পিত উন্নয়ন, রোগবালাই, পরিবেশ দূষণ ও কীটনাশকের অবাধ ব্যবহারের ফলে সারা বিশ্বে সবুজ ময়ূর আশংকাজনক হারে কমে যাচ্ছে
তথ্যসুত্র ও ছবিঃ উইকিপিডিয়া

শেয়ার করুন

Author:

A dedicated government professional with a passion for photography, book reading, and traveling. Holding a Bachelor of Social Science (BSS), I am also a professional graphics designer with extensive experience in the field. When I'm not working, I enjoy blogging to share my thoughts and experiences with a wider audience.