সর্বশেষ

মঙ্গলবার, ২ আগস্ট, ২০১৬

শেয়ালকাঁটা

শেয়ালকাঁটা

 শেয়ালকাঁটার দেখা মিলবে আমাদের গ্রামের আশেপাশের ঝোপঝাড়, খেত খামারের পাশে, পুরনো ভবনে পাশে। এসব এলাকায় শেয়ালের আবাস বলে গ্রামের মানুষ এঁকে শেয়ালকাঁটা নাম দিয়েছে। বন ও পাহাড়ি এলাকা ছাড়াও শেয়ালকাঁটা দেশের অসংখ্য জলাশয়, হাওর-বিল, পানা পুকুর থেকে শুরু করে সুন্দরবন ঘেঁষে সমুদ্রোপকূলের বিশাল এলাকায় চোখে পড়বে। পাতা বেশ ধারালো এবং তিখন কাঁটায় পরিপূর্ণ। দেখতে অনেকটা আফিম গাছের মত। আফিম এবং শেয়ালকাঁটা একই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।


বৈজ্ঞানিক নাম (Argemone Mexicana) আমাদের দেশে এসেছে সুদূর মেক্সিকো থেকে। ষোড়শ শতকে স্প্যানিশ বাণিজ্যিক জাহাজে আলুর বস্তা এবং মাটির সঙ্গে সরিষার দানার মত ছোট ছোট বীজ আমাদের দেশে চলে এসেছিল। এরপর ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। ভেষজ পণ্ডিতরা এঁকে অনেক নামে অলংকৃত করেছেন। যেমন- স্বর্ণক্ষীরা, স্বর্ণদুগ্ধা, রুক্সিনী, সুবর্ণা, হেমদুগ্ধী ও কাঞ্চনী। শেয়ালকাঁটার রস কুষ্ঠ রোগে ব্যবহৃত হয়। গাছের পীতবর্ণের রস গনোরিয়া ও উপদংশ রোগে উপকারী।



রবিবার, ৩১ জুলাই, ২০১৬

মেছো বিড়াল

মেছো বিড়াল

মেছো বিড়াল, ফিশিং ক্যাট (Felis viverrina) এখনো এদেশে দুর্লভ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় নি। চেহারা-আদল এবং গায়ের ডোরা প্রায় বাঘের মত হওয়ার কারণে এ প্রাণীকে অনেকেই ভয় পান। কেউ বলেন মেছো বাঘ, ছোট বাঘ, বাঘুইলা বা মেচি বাঘ। এদেরকে কোন কোন এলাকায় বাঘ বলার যথেষ্ট কারন রয়েছে। মেছো বিড়াল লেজসহ লম্বায় সাড়ে তিনফুট। ওজনে ১২-১৩ কেজি ভারী দেহের সাথে খাটো পা এদের আকৃতি অন্য সব বিড়াল থেকে কিছুটা আলাদা করে ফেলে। সামান্য বা আলগোছ হলুদে মেশানো ধূসর রঙের চামড়ায় মোটামুটি লম্বালম্বিভাবে কয়েক সারি বা গাড় হলুদ ডোরা রয়েছে।


মেছো বিড়াল বাংলাদেশের যে কোন জায়গায় পাওয়া যেতে পারে । তবে ঝোপঝাড় বা জঙ্গলযুক্ত এলাকায় ওদের দেখা মেলে বেশি। সকল বনাঞ্চলেই ওরা কমবেশি আছে। তবে এদের সংখ্যা দিন দিন কমছে।


মেছো বাঘ মূলত মাছ এবং কাঁকড়াভুক হলেও এদের খাদ্য তালিকায় শামুক, মোরগ-মুরগি, হাঁস, ছাগল, ভেড়া এবং বাছুর অন্তর্ভুক্ত। খাদ্যাভাব দেখা দিলে ওরা মানুষের ঘরে ঢুকে শিশু বা বাচ্চা তুলে নিএ যায়। এ কাজটি ওরা করে সাধারণত সন্ধ্যা বা রাতের বেলা। তখন গ্রামের আলোআধারিতে পুরো প্রানিতিকে না দেখতে পারার জন্য অনেকেই একে বাঘ বলে চিহ্নিত করে থাকেন। মাছ ধরার জন্য মেছো বিড়াল পানিতে নামে না। পানির উপর কোন গাছের ডালে বা পানির উপর জেগে থাকা কোন পাথরের উপরে বসে থাবা দিয়ে শিকার ধরে।
তথ্যসুত্রঃ ড. আলী রেজা খান (বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী),  ছবিঃ সংগ্রহ
নৃ-গোষ্ঠীঃ রাজবংশী

নৃ-গোষ্ঠীঃ রাজবংশী

রাজবংশীরা মূলত কৃষিজীবী, তবে মাছধরা এবং মাছ বিক্রয় এদের অন্যতম পেশা। মেয়েরা কুটির শিল্পের কাজে দক্ষ। পিতাই পরিবারের প্রধান। পিতার মৃত্যুর পর পুত্রসন্তান সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে থাকে। তাদেরকে ধর্মীয় আচারে শৈব বলে মনে করা হলেও শাক্ত, বৈষ্ণব, বৌদ্ধ, তান্ত্রিক প্রভৃতি বিশ্বাসের সমন্বয়ে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস রয়েছে। তারা মহাকাল শিব, বিষহরী (মনসা)র আরাধনা করেন এবং একই সঙ্গে দুর্গা, কালী (শ্যামা), লক্ষ্মী, জগন্নাথ, নারায়ণ, বিষ্ণু প্রভৃতি দেবদেবীরও পূজা করে। দেবদেবীর পূজার পাশাপাশি প্রাচীন কৃষিসংস্কৃতির প্রতীক ‘বারিধারা’ ব্রত কিংবা উর্বরতা ও প্রজননের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্রত বা অনুষ্ঠানাদি পালন করে। এরা প্রকৃতি উপাসকও বটে এবং পাহাড়, নদী, অরণ্য ও মৃত্তিকার পূজা করে থাকে। এরা ঘর-সংসারের মঙ্গল কামনায় বাস্ত্তদেবতা বাহাস্তো বা বাহুস্তো এবং শস্য রোপণের পূর্বে বলিভদ্র ঠাকুরের পূজা করে। এদের পূজা-পার্বণে নৃত্যগীতোৎসব আদিবাসীসুলভ সামাজিক প্রথারূপেই ব্যাপকভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। খরা, অনাবৃষ্টি উপলক্ষে অনুষ্ঠিত ‘হুদুমা’ পূজা রাজবংশীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান।

 রাজবংশী পুরুষরা ধুতি ও জামা পরে। বিয়ের সময় বর কনে উভয়ই পাড়বিহীন সাদা কাপড় পরে। আগে রাজবংশী নারীরা চারহাত দৈর্ঘ্য এবং আড়াই হাত প্রস্থের হাতে বোনা মোটা ধরনের বহু বর্ণ রঞ্জিত এক বস্ত্র পরিধান করতো। এটিকে বলা হতো ‘ফতা’। বর্তমানে সুতার অভাবে এটি আর তৈরি হয় না। নারীরা বিভিন্ন ধরনের গহনা ব্যবহার করেন। চুলের অলংকার হিসেবে তারা সিঁথা-পাটি, সেঁদ, বন ব্যবহার করেন। ওন্তি, এন্তি, সাদিয়া-পাত, গুজি, সোনা, সিসা, চাকি, সাকিরি প্রভৃতি হচ্ছে তাদের কানের অলংকার। গলায় সূর্যহার, চন্দ্রহার, শিকইল হার, কাঠি-মালা, ছোরা-কাঠি প্রভৃতি অলংকার ব্যবহার করে। কোমরে গোটা-খারু, গোকুল খারু, মোটা খারু, মুটিয়া-খারু, বাউটি-চুরাতি, রতনচুর এবং হাতে মোটা-খারু, শাঁখা-খারু, গজরা, সোমপাত্তি প্রভৃতি পরে। রাজবংশীরা বিভিন্ন গোত্রনাম গ্রহণ করেছে। তাদের গোত্রগুলি হলো: কাশ্যপ, শান্ডিল্য, পরাশর, ভরদ্বাজ, গৌতম, সবর্ণ, কপিল প্রভৃতি।




                                                                   রাজবংশী নারীদের ব্যবহৃত গহনা

রাজবংশীদের কোন লেখ্য ভাষা বা বর্ণমালা নেই। এদের ভাষা স্থানিক তথা আঞ্চলিক ভাষার এক মিশ্ররূপ। এরা যে আঞ্চলিক মিশ্র ভাষায় কথা বলে তা কারও কারও বিচারে ‘বিকৃত’ বাংলা। রাজবংশীদের বিবাহ প্রথায় সাঁওতাল, ওরাওঁদের বিবাহরীতির প্রভাব যথেষ্ট। বিবাহ বিচ্ছেদ, পুনর্বিবাহ ও বিধবা বিবাহ সমাজে প্রচলিত। তবে বিধবা বিবাহের ক্ষেত্রে দেবরদের দাবি অগ্রগণ্য। রাজবংশীরা মৃতদেহ পুড়িয়ে সৎকার কাজ সম্পন্ন করে। একমাস পর মৃত ব্যক্তির জন্য শ্রাদ্ধকর্ম অনুষ্ঠিত হয়।


                                                                রাজবংশীদের ব্যবহৃত কৃষিযন্ত্র 


তথ্যসুত্রঃ আহমদ রফিক (বাংলাপিডিয়া),  ছবিঃ সংগ্রহ

সবুজ ময়ূর

সবুজ ময়ূর

বুজ ময়ূর (Pavo muticus) (ইংরাজি: Green Peafowl) বা বর্মী ময়ূর Phasianidae (ফ্যাসিয়ানিডি) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত Pavo (পাভো) গণের অসাধারণ সুন্দর, ঝলমলে রাজকীয় ময়ূর। সবুজ ময়ূরের বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ ছোট ময়ূর (ল্যাটিন: pavo = ময়ূর; muticus = ছোট, ক্ষুদে বা সংক্ষিপ্ত)। সারা পৃথিবীতে এক বিশাল এলাকা জুড়ে এদের আবাস, প্রায় ৯ লাখ ৯১ হাজার বর্গ কিলোমিটার। আবাসস্থল এত বিশাল হলেও পুরো এলাকাটির মাত্র অল্পসংখ্যক এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে এদের বিস্তৃতি রয়েছে। আবার বিগত কয়েক দশকে এদের সংখ্যা ভয়াবহভাবে হ্রাস পেয়েছে। সেকারণে আই ইউ সি এন এই প্রজাতিটিকে Endengered

সবুজ ময়ুর

বা বিপন্ন বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে একসময় এরা প্রচুর পরিমাণে থাকলেও সম্প্রতি এদের দেখতে পাওয়ার কোন সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ নেই। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।
সমগ্র পৃথিবীতে আনুমানিক ১০ হাজার থেকে ১৯ হাজার ৯৯৯টি পূর্ণবয়স্ক সবুজ ময়ূর রয়েছে। অপ্রাপ্তবয়স্ক-প্রাপ্তবয়স্ক সব মিলিয়ে মোট সবুজ ময়ূরের সংখ্যা আনুমানিক ১৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার।


বিস্তৃতি
এক সময় সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশ জুড়ে সবুজ ময়ূরের অবাধ বিস্তার ছিল। বর্তমানে জীবিত ময়ূরের বড় অংশ কম্বোডিয়া, মিয়ানমারও ভিয়েতনামের পশ্চিমাংশে বসবাস করে। বাকি সবুজ ময়ূরের বসবাস উত্তর ও পশ্চিম থাইল্যান্ড, দক্ষিণ লাওস, চীনের হিনান প্রদেশ ও ইন্দোনেশিয়ার জাভায়। ভারতের মনিপুর প্রদেশে কদাচিৎ এদের দেখা মেলে। একসময় মিজোরামে এদের স্থায়ী আবাস হলেও এখন আর সেখানে এদের দেখা যায় না। সর্বশেষ ২০০৭ সালে মিজোরামের দক্ষিণে একটি সবুজ ময়ূর দেখা গিয়েছিল। বাংলাদেশে ১৯৪০ এর দশকেও সবুজ ময়ূর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা ছিল। এখনও বান্দরবানের গহীন বনে সবুজ ময়ূর থাকতে পারে। মালয়েশিয়া থেকে বহু আগেই এরা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।


উপপ্রজাতি
এ পর্যন্ত সবুজ ময়ূরের মোট তিনটি উপপ্রজাতি সনাক্ত করা গেছে।উপপ্রজাতিগুলো হচ্ছে:
  • P. m. spicifer (Shaw & Nodder, 1804) – উত্তর-পূর্ব ভারত, বাংলাদেশ এবং উত্তর-পশ্চিম মিয়ানমারে এদের সহজেই দেখা মিলত। এই উপপ্রজাতিটি সম্ভবত বিলুপ্ত (Possibly extinct)। উপপ্রজাতিটিতে নীলের ভাগ বেশি ও উজ্জ্বলতা বেশ কম।
  • P. m.imperator (Delacour, 1949) – মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও চীনে এদের দেখা যায়। P. m.imperator প্রায় muticusএর মতই, তবে দেহতল বেশি গাঢ় ও চোখের পাশের হলুদ ছোপটি কম উজ্জ্বল।
  • P. m. muticus (Linnaeus, 1758) – কেবলমাত্র ইন্দোনেশিয়ার জাভায় দেখা যায়। একসময় মালয় উপদ্বীপে বিস্তৃত থাকলেও সে এলাকায় এরা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। উপপ্রজাতিগুলোর মধ্যে এই উপপ্রজাতিটি সবচেয়ে উজ্জ্বল সবুজ আর এর ডানার পালকে গাঢ় সবুজ ও নীল বর্ণ থাকে।




বিবরণ
সবুজ ময়ূর দেখতে অনেকটা নীল ময়ুরের মতই, তবে শরীরে ঝলমলে ধাতব সবুজ পালকের আধিক্য রয়েছে। এরা বেশ বড় আকারের ভূচর পাখি। এদের দৈর্ঘ্য ১০০-৩০০ সেন্টিমিটার, ডানা ৪৫ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ৪.ত সেন্টিমিটার, পা ১৫.২ সেন্টিমিটার, লেজ ৪.৩ সেন্টিমিটার এবং ওজন ৪.৫ কিলোগ্রাম। পুরুষ ময়ূরের পেখম ১৫০ সেন্টিমিটার।পুরুষ ময়ূরের চেহারা ও আকার স্ত্রী পাখির থেকে কিছুটা আলাদা। পুরুষ ময়ূরের পিঠ ও ঘাড় সবুজ; ঘাড়, গলা ও বুকের পালক আঁশের মত উঁচু। পালকহীন মুখের চামড়া নীল ও হলুদে মেশানো। ডানা-ঢাকনি সবুজ রঙের। ডানার মধ্যভাগ ও গোড়ার পালক বাদামি; লেজের পেখমের প্রান্তে কালো চক্রের মধ্যে বেগুনী ফোঁটা দেখা যায়। দেহতলে সরু কালো ধাতব তামাটে, সবুজ ও বেগুনী দাগ থাকে। এমনিতে স্ত্রী ময়ূর বা ময়ূরীর চেহারা সামনে থেকে পুরুষ ময়ূরের মতই, তবে দেহের কিছু কিছু অংশ ফ্যাকাসে। পিঠ গাঢ় বাদামি বর্ণের। লেজ পেখমহীন। ডানা-ঢাকনি, পিঠের শেষভাগ ও কোমর কালচে বাদামি। লেজে পীতাভ, বাদামি ও কালো রঙের ডোরা আছে। স্ত্রী ও পুরুষ উভয় ময়ূরের সুঁচালো ও বিপরীতমুখী। চোখ কালো, পা ও ঠোঁট ধূসর। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি দেখতে ময়ূরীর মত, কেবল কোমরে সবুজাভ ও তামাটে বর্ণ থাকে না।
স্বভাব
সবজ ময়ূর সাধারণত ছোট দলে বিচরণ করে; এক একটি দলে একটিমাত্র পুরুষ ময়ূর ও তিন থেকে পাঁচটি ময়ূরী থাকে। এরা স্বভাবে দিবাচর, তবে ভোরবেলা আর গোধূলিতে বেশি সক্রিয় থাকে। জোরে ডানা ঝাপটে এরা দ্রুত উড়তে পারে। ময়ূর উঁচুস্বরে ইয়েই-অও….. স্বরে ডাকে যা বহু দূর থেকেও শোনা যায়। ময়ূরীর ডাক অনেকটাঅ্যাও-অ্যা….। ভয় পেলে এরা ডাকে কের্-র-র-র-রু….। এক ময়ূরের ডাকের জবাবে অন্য ময়ূরও ডেকে ওঠে। বেশিরভাগ এলাকাতেই এরা লাজুক স্বভাবের এবং কাছে গেলেই লুকিয়ে পড়ে বা উড়ে যায়। তবে যেসব এলাকায় এদের তেমন একটা ক্ষতি করা হয় না, সেসব এলাকায় এরা মানুষের আশেপাশে পোষা পাখির মত ঘুরে বেড়ায়।
বিচরণস্থল
সবুজ ময়ূরের বিচরণ সমূদ্রসমতল থেকে সর্বোচ্চ ৩০০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত হয়। সবুজ ময়ূর প্রধানত হালকা বনভূমি, বনভূমি সংলগ্ন ঘাসবন ও খোলা জায়গা, সাভানা, বনসংলগ্ন নদীর পাড়, ক্ষেতখামার ইত্যাদি এলাকায় খাবারের খোঁজে ঘুরে বেড়ায়। অনেকসময় গৃহপালিত হাঁস-মুরগীর সাথে ঘুরে ঘুরে খাবার খায়। এদের জীবনধারণের জন্য প্রচুর পানির দরকার হয়, সেকারণে পানির উৎসের আশেপাশেই এদের দেখা যায়।
খাদ্যাভ্যাস
এদের জাতভাই নীল ময়ূরের মত সবুজ ময়ূরও সর্বভূক। খাদ্যতালিকায় রয়েছে বীজ, শস্যদানা (মূলত ধান), তৃণ, কচি উদ্ভিদের কান্ড, গাছের পাতা, ফুলের কলি, রসালো ফল ইত্যাদি। এছাড়া এরা ঘাসফড়িং, গুবরে পোকা, মথ, ফড়িং, ঝিঁঝিঁ পোকাসহ বিভিন্ন জাতের পোকামাকড়, ব্যাঙ, গিরগিটি ও ছোট সাপ খায়। মটরশুঁটি আর মিষ্টি আলুর মৌসুমে এরা ক্ষেতে হানা দিয়ে ফসল সাবাড় করে। মাটি আঁচড়ে, ঝরা-পাতা উল্টে এরা বনতলে খাবার খুঁজে বেড়ায়।
প্রজনন
যদিও একটি ময়ূরকে ঘিরে একাধিক ময়ূরী নিয়ে একটি দল তৈরি করার ব্যাপারটা জানা যায়, তবুও দলগুলো স্থায়ী হয় না। প্রকৃতপক্ষে ময়ূর তার এলাকায় অনুপ্রবেশকারী একটি ময়ূরীর (কখনও কখনও একাধিক, তবে এমনটি কমই ঘটে) সাথে জোড়া বাঁধে। আর বাকি ‘ময়ূরীরা’ আসলে অপ্রাপ্তবয়স্ক ময়ূর যারা ঐ ময়ূরীর সন্তানমাত্র। আবদ্ধ অবস্থায় সবুজ ময়ূরের একগামী স্বভাবের মাধ্যমে একথার সত্যতা মেলে। নীল ময়ূরের সাথে সবুজ ময়ূরের এটি আর একটি পার্থক্য।
জানুয়ারি থেকে মে এদের প্রধান প্রজননকাল। প্রজননকালে পুরুষ ময়ূরেরা কঠিনভাবে তাদের নিজ নিজ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিটি ময়ূর তার প্রতিবেশী ময়ূরের থেকে ১০০ থেকে ৪০০ মিটারের মত দূরত্ব বজায় রাখে। এসময় এরা পেখম মেলে ও ধীরে ধীরে ঘুরে ঘুরে ময়ূরীর দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করে। ময়ূরী একাই বাসা বানাবার জন্য জায়গা নির্ধারণ করে এবং ঘন ঝোপের নিচে মাটিতে বাসা করে। বাসা বানানো শেষে ৩-৮টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলোর বর্ণ পীতাভ। ডিমগুলোর মাপ ৭.২ × ৫.৩ সেন্টিমিটার। কেবল স্ত্রী ময়ূর ডিমে তা দেয়। ২৬-২৮ দিন পর ডিম ফুটে ছানা বের হয়। ছানারা খুব কম বয়সেই উড়তে শিখে যায়। অপ্রাপ্তবয়স্করা মায়ের সাথে ঘুরে বেড়ায়। সাধারণত ময়ূর দুই বছরে এবং ময়ূরী এক বছরে বয়োঃপ্রাপ্ত হয়।
অস্তিত্বের সংকট
সবুজ ময়ূর খুব সরব পাখি। একটু শব্দ হলে বা বিশ্রামের সময়ে এরা ডেকে ওঠে। ফলে এরা শিকারীর সহজ শিকারে পরিণত হয়। আবার বড়সড় আকার ও ঝলমলে পালকের জন্য এরা খুব সহজেই দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়। নির্বিচারে শিকারের ফলে দিন দিন এরা সংখ্যায় কমে যাচ্ছে। এছাড়া বেআইনী ব্যবসা, আবাসস্থল ধ্বংস, বিচ্ছিন্ন বিস্তৃতি, অপরিকল্পিত উন্নয়ন, রোগবালাই, পরিবেশ দূষণ ও কীটনাশকের অবাধ ব্যবহারের ফলে সারা বিশ্বে সবুজ ময়ূর আশংকাজনক হারে কমে যাচ্ছে
তথ্যসুত্র ও ছবিঃ উইকিপিডিয়া

শনিবার, ৩০ জুলাই, ২০১৬

শকুনঃ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে

শকুনঃ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে

কুন ( ইংরেজি: Vulture) এক প্রকার পাখি। এটি মৃত প্রাণীর মাংস খেয়ে থাকে। সাধারণত এরা অসুস্থ ও মৃতপ্রায় প্রাণীর চারিদিকে উড়তে থাকে এবং প্রাণীটির মরার জন্য অপেক্ষা করে। পাখিগুলো তীক্ষ্ম দৃষ্টির অধিকারী শিকারি পাখিবিশেষ।


শকুনের গলা, ঘাড় ও মাথায় কোনো পালক থাকে না। প্রশস্ত ডানায় ভর করে আকাশে ওড়ে।লোকচক্ষুর আড়ালে মহীরুহ বলে পরিচিত বট, পাকুড়, অশ্বত্থ, ডুমুর প্রভৃতি বিশালাকার গাছে সাধারণত শকুন বাসা বাঁধে। সাধারণত গুহায়, গাছের কোটরে বা পর্বতের চূড়ায় ১-৩টি সাদা বা ফ্যাকাসে ডিম পাড়ে।
সারা বিশ্বে প্রায় ১৮ প্রজাতির শকুন দেখা যায়, এর মধ্যে পশ্চিম গোলার্ধে ৭ প্রজাতির এবং পূর্ব গোলার্ধে (ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়া) ঈগলের সাথে সম্পর্কিত ১১ প্রজাতির শকুন দেখা যায়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশে  প্রায় ৬ প্রজাতির শকুন রয়েছে, এর মধ্যে ৪ প্রজাতি স্থায়ী আর ২ প্রজাতি পরিযায়ী। শকুন বা বাংলা শকুন ছাড়াও এতে আছে রাজ শকুনগ্রীফন শকুন বা ইউরেশীয় শকুন হিমালয়ী শকুনসরুঠোঁট শকুনকালা শকুন ও ধলা শকুন। তবে শুধু গ্রীফন প্রজাতির শকুনই মাঝে মাঝে দেখা যায় (পরিপ্রেক্ষিত ২০১০)। এসব প্রজাতির শকুনই সারা বিশ্বে বিপদাপন্ন। স্থায়ী প্রজাতির মধ্যে রাজশকুন মহাবিপন্ন ।এটি ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর জন্যে ঠোঁটে পাথরের টুকরো বহন করে ও ডিমের উপর নিক্ষেপ করে।

বাংলাদেশে এখন মাত্র কয়েকশ বাংলা শকুন অবশিষ্ট আছে। সেজন্য এ পাখিটি বিশ্বের ‘মহাবিপন্ন প্রাণি’র তালিকায় রয়েছে। আমাদের দেশে একে এখনো বিপদগ্রস্তের তালিকায় রাখা হয়নি। তবে বন্যপ্রাণী আইনে এটি সংরক্ষিত।
মৃতপ্রাণী খায় বলে একে মাংসাশি পাখি বলে। এর দেহ বিশাল। ডানা প্রশস্ত। দেহের রঙ কালচে। মাথা ও ঘাড় পালকহীন। কান লতিকাহীন। ঠোঁট সরু ও লম্বা। লেজের পালক সংখ্যা ১২-১৪টি। এর দৈর্ঘ্য ৯০ সেমি, ওজন ৪.৩ কেজি, ডানা ৫৫ সেমি, ঠোঁট ৭.৬ সেমি, পা ১১.৬ সেমি ও লেজ ২২.৫ সেমি। এদের খাবারের তালিকায় রয়েছে মৃতপ্রাণী ও পচামাংস। সেপ্টেম্বর-মার্চ মাসে এরা ডিম পাড়ে মাত্র একটি করে। ডিমের মাপ ৮.৬ গুণ ৬.৪ সেমি। ৪৫ দিনের মাথায় এদের ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। উঁচু গাছ বা দালানে ডালপালা দিয়ে মাচার মতো করে বাসা বানায় এরা। আর এক বাসাতেই থাকে বছরের পর বছর।

বাংলা শকুন
বাংলাদেশে মোট ৬  প্রজাতির দেখা পাওয়া যেত। শকুন, রাজ শকুন, সাদা গিদরী বা গিন্নী শকুন, লম্বা ঠোঁট শকুৃন আমাদের দেশীয় প্রজাতি। আর ভ্রমণকারী হিসেবে কালো শকুন আর গ্রিফন শকুন ছিল। রাজ শকুন শেষবারের মত দেখা গেছে ৮০’র দশকে। এখনও হয়ত কোথাও টিকে রয়েছে। তবে লোকচক্ষুর অন্তরালে। লম্বা ঠোঁট শকুন ১৯৯২ সালে ভৈরবে পক্ষিবিদ পল থমসন শেষবারের মতন দেখেন। গিন্নী শকুনের শেষ দেখাও ১৯৮৪ সালে পল থমসনের চোখে। কালো শকুন ১৯৮৭ সালের নভেম্বরে ধরা পড়ে চাঁদপুরে। পরে এটিকে কুমিল্লা চিড়িয়াখানায় রাখা হয়। গ্রিফন শকুন ১৮ নভেম্বর ১৯৯২ সালে শেষবারের মত দেখা যায় ভৈরবে।


বাংলা শকুন টিকে রয়েছে কোন রকমে। অথচ সত্তর দশকে রাজ শকুন আর বাংলা শকুনে ছেয়ে ছিল ঢাকা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ চিত্রগুলোতে দেখা যায় দল বেধে মৃতদেহের উপর বসে আছে তারা। সত্তরের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির বুদ্ধ নারিকেল গাছের সারিতে আর পলাশী ব্যারাকের কাছের উঁচু গাছগুলোতে দেখা যেত বাংলা শকুনের। এখন বাংলা শকুন ছাড়া আর কোন শকুন কারো চোখে পড়ে না। গোটা বাংলাদেশ জুড়ে মোট শকুনের সংখ্যা ২০০০টিও নয়’ বলে জানিয়েছেন বন অধিদপ্তর।
বাংলা শকুনের সবচেয়ে বড় দলটি এখন রয়েছে শ্রীমঙ্গলের কালাছড়া এলাকায়। সেখানে একসাথে প্রায় ৪৭টি শকুন বাস করে। গত বছর বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাবের সভাপতি ইনাম আল হকের ক্যামেরায় ধরা পড়ে এই শকুনের দলটি। হবিগঞ্জের রেমা কালেঙ্গায় রয়েছে ২০টি শকুন। সুন্দরবনের দিকে বেশ বড় কয়েকটি দল রয়েছে।
তথ্য ও ছবিঃ সংগ্রহ
টুনটুনি

টুনটুনি

টুনটুনি আকারে ছোট পাখি। এদের যত চালাক পাখি ভাবা হয় আসলে তা নয়। এরা যেমন চালাক তেমন বোকা। টুনটুনি বিপদ দেখলেই চেঁচামেচি করে। ফলে সহজেই শত্রুর কবলে পড়ে। টুনটুনির ইংরেজী নাম Common tailbird অর্থাৎ দর্জি পাখি। এরা গাছের পাতা ঠোঁট দিয়ে সেলাই করে বাসা বানায়। বৈজ্ঞানিক নাম–Orthotommus sutoriu দেহের গঠনঃ টুনটুনির বুক ও পেট সাদাটে। অনেকটা মাটির ঢিলার মত। ডানার উপরিভাগ জলপাই-লালচে। মাথা জলপাই-লালচে। চোখের মনি পাকা মরিচের মত।বুক সাদা পালকে ঢাকা। লেজ খাড়া, তাতে কালচে দাগ আছে। ঋতুভেদে পিঠ ও ডানার রঙ কিছুটা বদলায়।

টুনটুনি বিভিন্ন রকম খাবার খায়। এরা অনেক অপকারী পোকামাকড়,কীটপতঙ্গ খাদ্য হিসেবে খায়। তাছাড়াও ছোট কেঁচ, মৌমাছি, ফুলের মধু, রেশম মথ ইত্যাদি খাদ্য হিসেবে গ্রহন করে। ধান-পাট-গম পাতার পোকা, শুয়োপোকা ও তার ডিম, আম পাতার বিছা পোকা তাদের খাদ্য তালিকায় আছে। টুনটুনির বাসা খুব বেশি উচুতে হয়না। সাধারনত এরা ৬-১০ সেমি উচ্চতায় বাসা বাধে। ছোট গুল্ম জাতীয় গাছ অথবা ঝোপঝাড় এদের প্রধান পছন্দ।শিম, লাউ, কাঠ বাদাম, সূর্যমূখী, ডুমুর, লেবু এগুলো গাছে এরা বেশি বাসা বাধে।পুরুষ ও স্ত্রী পাখি মিলে বাসা তৈরী করে।
তথ্যসুত্রঃ উইকিপিডিয়া, ছবিঃ সংগ্রহ


বাংলাদেশের ফুলসমূহ

বাংলাদেশের ফুলসমূহ

(১) উভয়পদ্ম (হিমচাপা)

বুধবার, ২৭ জুলাই, ২০১৬

'প্রথম বিশ্বযুদ্ধ'

'প্রথম বিশ্বযুদ্ধ'

'প্রথম বিশ্বযুদ্ধ'

First World war Ai Image

যেভাবে শুরু হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম এত অস্ত্র এবং রক্তের লড়াই ছিল 'প্রথম বিশ্বযুদ্ধ'। ১৯১৪ সালে যদি গ্যাভ্রিলো প্রন্সিপের অস্ত্রের মুখ থেকে গুলিটা না বের হত, তাহলে হয়ত মানবজাতিকে এত রক্তক্ষয়ী একটা যুদ্ধ দেখতে হত না। ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি'র সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনার মধ্য দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর মিত্রপক্ষের সাথে জার্মানীর যুদ্ধবিরোধী চুক্তি সাক্ষরের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়। কিন্তু এই যুদ্ধ শুরুর আছে একটা দীর্ঘ ইতিহাস।

কেনো শুরু হয়েছল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সেটা জানতে হলে আমাদেরকে আরো ৪০ বছর পিছনে যেতে হবে। আমি খুব সহজ ভাষায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর গল্পটা তুলে ধরার চেষ্টা করব। ১৮৭০ আধুনিক জার্মানের প্রতিষ্ঠাতা বিসমার্কের (Prince Otto von Bosmark) এর নেতৃত্বে জার্মানি আর ইটালীর একত্রীকরণের কাজ সম্পূর্ন হয়। একই সাথে ইউরোপে দুই দুইটা বড় শক্তির আত্মপ্রকাশের ফলে ইউরোপের শক্তিসাম্য বা Balance of Power এর বিরাট পরিবর্তিন ঘটে। এই সময়টায় ইউরোপের দেশগুলো আফ্রিকা মহাদেশ এবং মধ্য এশিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তারে বেশ আগ্রহী এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিল। ইউরোপের দেশগুলো মূলত আফ্রিকাতেই তাদের রাজ্য বিস্তারে বেশি আগ্রহী ছিল কারণ আফ্রিকায় প্রচুর কাঁচামাল পাওয়া যায়। পূর্ব এশিয়ার জাপানও রাজ্য বিস্তারে বেশ তৎপর ছিল।

জার্মানীর একত্রীকরণের শেষ পর্যায়ে বিসমার্ক Franco-Prussian War (ফ্রাঙ্ক-প্রুশিয়ান যুদ্ধ) এ ফ্রান্সের পরাজয়ের সুযোগে আলসেস (Alsace) ও লরেন (Lorraine) প্রদেশ দুটো জার্মান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করেন। এর ফলে ফ্রান্স আর জার্মানির চিরশত্রুতা নতুন করে বৃদ্ধি পায়। সেই সাথে জার্মানির কবল থেকে হারানো প্রদেশ দুটো পুনরুদ্ধারের জন্য ফ্রান্স সুযোগ খুঁজতে থাকে। কিন্তু চতুর বিসমার্ক তো সে সুযোগ দেন ই নি বরং যাতে কূটনৈতিকভাবে এবং ইউরোপিয়ো রাজনীতি থেকে ফ্রান্সকে বিচ্ছিন্ন করা যায়, সে সুযোগ খুঁজতে থাকেন। এজন্য প্রথমে তিনি ১৮৭৯ তিনি জার্মানি ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির মধ্যে দ্বৈত মৈত্রীচুক্তি (Duel Alliance) করেন। এরপর ১৮৮১ সালে জার্মান সম্রাট কাইজার, অস্ট্রিয়ার সম্রাট (যিনি হাঙ্গেরির সম্রাট হিসেবেও পরিচিত) এবং রাশান সম্রাট জার এর মধ্যে তিন সম্রাটের মৈত্রীচুক্তি সম্পাদন করেন। যেটা League of Three Emperor's নামে পরিচিত। এরপর ইটালির সাথে বিসমার্কের ভাল সম্পর্ক থাকার দরুন তিনি ১৮৮২ সালে দ্বৈত মৈত্রীচুক্তিতে ইটালিকেও অন্তর্ভূক্ত করেন। এদিকে আবার আগে থেকেই অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি এবং রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্কটা খারাপ। আবার রাশিয়া এবং অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি দুই সাম্রাজ্যেরই রাজার দ্বারা পরিচালিত একনায়কতন্ত্র। তাই জার্মানি - ইটালি - অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির এক হওয়াটা রাশিয়া যাতে মনে না করে যে এটা তাদের বিরুদ্ধে এজন্য বিসমার্ক রাশিয়ার সাথে ১৮৮৭ সালে পুননিশ্চিত চুক্তি বা Reinsurance Treaty সম্পাদন করেন। মূলত এটা ছিল লোক দেখানো। কিন্তু এরমধ্য দিয়ে ইউরোপীয় রাজনীতি থেকে ফ্রান্স ছিটকে পড়ে। কিন্তু কথায় আছে রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। বিপত্তিটা ঘটল যখন ১৮৮৮ সালে সম্রাট দ্বিতীয় উইলিয়াম (William II) জার্মানির নতুন কাইজার হন। যিনি বিশ্বরাজনীতির (Weltpolitik) প্রবক্তা হিসেবে পরিচিত। এই নতুন কাইজারের সময় ফ্রান্স তার বেড়াজাল থেকে বের হওয়ার সুযোগ পায়। এই নতুন কাইজার ছিলেন উচ্চাভিলাষী। তিনি বহির্বিশ্বে জার্মান উপনিবেশ স্থাপন এবং বিশেষত বলকান উপদ্বীপে সম্প্রসারণবাদী নীতির উপর জোর দেন। বিসমার্ক এতে বাঁধা দেন। ফলে কাইজার ১৮৯০ সনে বিসমার্ককে চ্যান্সেলরের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন। এর ফলে বিগত বছরগুলোতে আনা বিসমার্কের সকল চুক্তি ব্যবস্থাও ভেঙ্গে পড়ে। ফলে সুবিধাটা হল ফ্রান্সের। ফ্রান্স তার বিচ্ছিন্ন অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে ১৮৯৪ সালে রাশিয়ার সাথে আঁতাত (Entente) গড়ে তোলে।

এতদিন ব্রিটেন ইউরোপীয় রাজনীতি থেকে দূরে সরে ছিল এবং দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করছিল। ইতোমধ্যে ১৮৯৭ সালে জার্মানি নতুন আইন করে ব্রিটেনের সাথে উপনিবেশিক প্রতিযোগিতার জন্য জার্মানি বিরাট নৌবহর তৈরি করা শুরু করে। যেটা অ্যাডমিরাল তিরপিজ'স ল (Admiral Tirpitz's Law) নামে পরিচিত ছিল। এর ফলে নড়েচড়ে বসে ব্রিটেন। জলপথে তাদের আধিপত্য হুমকীর সম্মুখীন হয়। ফলে ব্রিটেন ইউরোপীয় রাজনীতিতে পুনরায় ফিরে আসার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এবং ১৯০৪ সালে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ দিপাক্ষিক চুক্তি (Entente Cordiale) সম্পাদিত হয়। ১৯০২ সালে ব্রিটেন আর জাপান মৈত্রীচুক্তি করে। ১৯০৪-০৫ সালে রুশ-জাপানীজ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে তৎকালীন সাম্রাজ্যবাদী জাপান সাম্রাজ্যের কাছে রাশিয়ার পরাজয় ঘটে। যুদ্ধ পরাজয়ের হলে রাশিয়া একদম একাকি হয়ে পড়ে। তখন তারা একরকম বন্ধুহীন অবস্থা পার করছিল। তারা ইউরোপের দেশগুলোর সাথে মৈত্রীতে আসার সুযোগ খুঁজতে থাকে। এরমধ্যে ১৯০৫-০৬ সালে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে "মরক্কো সমস্যা (The Moroccan Crisis)।

 ফ্রান্স ও ব্রিটেনের মধ্যে যে নতুন Entente Cirdiale বা আঁতাত হয়েছে সেটা পরীক্ষা করার জন্য জার্মানি একটা কূটনৈতিক চাল চালার চেষ্টা করে। জার্মানি মরক্কো'র স্বাধীনতা বা অধীনতার প্রশ্নে মরক্কোর সুলতানকে তাদের স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য সব রকম সাহায্য করার কথা ঘোষনা দেয়। আফ্রিকার একমাত্র এই দেশটাই তখন কোন ইউরোপিয়ান দেশের অধীনে ছিল না এবং সেই সময় ফ্রান্স মরক্কো দখলের পঁয়তারা করছিল এবং ইজিপ্ট বা মিশর ব্রিটিশদের অধীনে ছিল। এর জন্য জার্মানি মরক্কোর ভবিষ্যতের জন্য একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনের দাবী করে যেটা দুবছর পর ১৯০৬ সালে স্পেনের আলজিসিরাস এ অনুষ্ঠিত হয়। জার্মানি দেখতে চাচ্ছিলো এতে ফ্রান্স আর বৃটেনের প্রতিক্রিয়া কি হয়! কিন্তু জার্মানি এ পরীক্ষায় হেরে যায়। তাছাড়া জার্মানি ফ্রান্স আর ব্রিটেনের চুক্তি বিশ্বাস করত না কারণ তারা জানত অ্যাংলো-ফ্রান্স সম্পর্কের একটা বৃহৎ ইতিহাস আসে। এটা জার্মানীর একটা বড় পরাজয় ছিল যার ফলে ফ্রান্স-ব্রিটেন তাদের মৈত্রীচুক্তিকে সামরিক রূপ দিতে বাধ্য হয়। এ পর্যন্ত ইউরোপীয় রাজনীতিতে একটি বড় শক্তি গড়ে ওঠে। সেটি হচ্ছে: - জার্মানি - অস্ট্রিয়া - হাঙ্গেরি - ইটালি ফ্রান্স- ব্রিটেন এ পর্যন্ত বড় শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি যদিও দুই দেশের অস্ত্রে শস্ত্রে সজ্জিত। বড় হগে ওঠেনি কারণ ব্রিটেন ছিল ইউরোপের মূল ভূখণ্ড থেকে দূরে। আর জার্মানি, ইটালি এবং অস্ট্রিয়া - হাঙ্গেরি ছিল ফ্রান্সের তিন দিকে ঘেরা। সুতরাং ইউরোপের অন্য তিন দিকে তখনো ফ্রান্সের বন্ধু কেউ ছিল না। আর ফ্রান্সকে আগেই জার্মানি ইউরোপের মূল রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। এ পর্যন্ত আমরা ১৯০৬ সালে মরক্কো সমস্যা পর্যন্ত আলোচনা করেছি এবং তিন বৃহৎ মিত্রশক্তি দেখেছি। যারা হচ্ছে যথাক্রমে জার্মানি, ইটালি এবং অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি। বিশ্বযুদ্ধ শুরুর কয়েকটি পয়েন্ট যদি দাঁড় করাই তাহলে পাই, ১. ব্রিটেন আর জার্মানির মধ্যে নৌযান প্রতিযোগিতা।

কারণ ১৯০৬ সালে ব্রিটেন তাদের প্রথম 'ড্রেডনাউট (Dreadnought)' ব্যাটলশিপ তৈরি করে। আর জার্মানিও ততোদিনে বেশ উন্নতি করেছে ১৮৯৭ সালের 'Tirpitz's Navy Law' এর আওতায়। ২. ১৮৭১ সালের ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধে ফ্রান্স জার্মানদের কাছে আলসেস আর লোরিন হারানো ৩. ১৯০৭ সালে ব্রিটেন আর রাশিয়া মৈত্রীচুক্তি করে। এরমধ্যে দিয়ে ব্রিটেন, রাশিয়া এবং ফ্রান্স মৈত্রীচুক্তির আওতায় পরে এবং জার্মানী এটাকে তাদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত বলে অভিযুক্ত করে। ৪. বসনিয়ান সমস্যার পর অস্ট্রিয়া বসনিয়া তাদের দখলে নিলে রাশিয়া বলকান দেশগুলোতে অস্ট্রিয়ার উপস্থিতিতে ভীয় হয়ে পড়ে। ৫. সার্বিয়ান জাতীয়তা। এটাই সবচেয়ে বড় কারণ ছিল। সার্বরা সবসময় সার্বভৌমত্ব চেয়ে এসেছে। হ্যাবসবার্গ সাম্রাজ্যের অধিনে থাকা যুগোস্লাভিয়া অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির দখলে ছিল। যেখানে বহু সার্ব আর ক্রোট রা থাকত এবং সার্বিয়া সবসময় তাদের এক করতে চেয়েছিলো। আর এই হার্বসবার্গ সাম্রাজ্যে বহু জাতীয়তার মানুষ ছিল যেমন, জার্মান, চেক, স্লোভাক, পোলিশ, রোমানিয়ান, স্লোভেন, হাঙ্গেরিয়ান, সার্ব, ক্রোট। এর মধ্যে থেকে যদি সার্ব এবং ক্রোটরা বের হয়ে যায় তবে অন্যান্য জাতিগুলোও আলাদা হতে চাইবে ফলে ভেঙ্গে যেতে পারে হ্যাবসাবার্গ সাম্রাজ্য। এজন্য অস্ট্রিয়া একটা "প্রতিরোধক যুদ্ধ (Preventive War)" চেয়েছিল যাতে সার্বিয়ার আগ্রহকে দমিয়ে রাখতে পারে এবং যাতে সার্বিয়া বড় কোন শক্তি হয়ে উঠতে না পারে। এই কারণগুলো ছিল বিশ্বযুদ্ধ শুরুর কিছু প্রত্যক্ষ কারণ। আরো কিছু উল্লেখযোগ্য কারণ আছে। এক এক করে আলোচনা করছি। ইয়োমধ্যে মরক্কো সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছি। এরপর আসি ১৯০৭ সালে। ১৯০৭ সালে ব্রিটেন আর রাশিয়ার মাঝে মৈত্রীচুক্তি হয়। জার্মানদের কাছে যেটা একটা বড় পরাজয় ছিল। ১৮৯৪ সালে রাশিয়া আর ফ্রান্স চুক্তি করে আর ফ্রান্স হচ্ছে ১৯০৪ সালের করা ফ্রান্স-ব্রিটেনের "Entente Cordiale" চুক্তি করা ব্রিটেনের সহযোগী। এর আগে ব্রিটেন রাশিয়াকে তাদের একটা বড় হুমকি মনে করত ভারতবর্ষে ব্রিটেন সাম্রাজ্যের কারণে। কিন্তু ইতোমধ্যে অবস্থা পাল্টেছে। ১৯০৪-০৫ সালের রাশিয়া-জাপান যুদ্ধে রাশিয়ার হারার ফলে তাদের শক্তি অনেক কমে যায় এবং ব্রিটেন বুঝতে পারে রাশিয়ার সক্ষমতা। আর রাশিয়া খুঁজছিলো এক দীর্ঘসময়ের বন্ধু। এছাড়া শিল্পবিপ্লবের ফলে রাশিয়াতে নতুন যন্ত্রাংশ ব্যবহারে যে জটিলতা ছিল তা অনেকাংশে শিথিল হয়ে পরে। এবং রাশিয়া ব্রিটেনের শিল্পবিপ্লবের দিকে আগ্রহী হয়ে পড়ে। এই চুক্তির ফলে রাশিয়া এবং ব্রিটেনের মাঝে যে দূরত্বগুলো ছিল সেগুলো অনেকাংশে দূর হয়। এটা কোন সামরিক চুক্তি ছিল না। কিন্তু এ চুক্তির ফলে ফ্রান্স, রাশিয়া আর ব্রিটেন যে মৈত্রীতে আবদ্ধ হয় জার্মানী সেটাকে তাদের বিরুদ্ধে গঠিত শক্তি হিসেবে মনে করে। এরপর ১৯০৮ সালে হয় 'বসনিয়া সমস্যা'। এটা একটা বড় সমস্যার সৃষ্টি করেছিল।

বসনিয়ায় ছিল তুরস্কের বর্ধিতাংশে দেখা দেয় বিপ্লব। এর সুযোগ নেয় অস্ট্রিয়া। তারা দখল করে বসনিয়া। এদিকে অন্যদেরও বসনিয়া নিয়ে আগ্রহ ছিল ব্যাপক। বসনিয়া সার্বিয়ার পাশের রাষ্ট্র। বসনিয়া নিয়ে সার্বিয়ারও আগ্রহ ছিল চূড়ান্ত কারণ বসনিয়ায় ৩০ লক্ষের মত সার্বরা থাকত যার মধ্যে সার্ব ছাড়াও ছিল ক্রোট এবং মুসলিম। সার্বিয়া তাদের ঘনিষ্ঠ সার্বদের কাছে সাহায্য চায়। রাশিয়া বিশ্বব্যাপী একটা সম্মেলন ডেকে ব্রিটেন আর ফ্রান্সের সমর্থন চায়। কিন্তু ব্যাপারটা পাল্টে গেল অন্যভাবে যখন সবাই দেখলো যদি এখানে যুদ্ধ শুরু হয় তবে জার্মানি অস্ট্রিয়াকে সবরকম সামরিক সহযোগিতা দিবে। ফ্রান্স বলকান অঞ্চলে কোন যুদ্ধে জড়িত হওয়ায় আগ্রহি ছিল না। ব্রিটেন তাদের আভিজাত্য থেকে কখনোই চাইত না জার্মানদের সাথে যুদ্ধে যেতে। আর জাপানের কাছে যুদ্ধে হারার পর রাশিয়া তখনো চুপচাপ। আরেকটা যুদ্ধের জন্য তারা ঝুঁকি নিতে আগ্রহী ছিল না। ফলে সার্বিয়া সাহায্যের জন্য কাউকেই সাথে পেল না। কোন আন্তর্জাতিক সম্মেলনও হল না। অস্ট্রিয়া বসনিয়াকে তাদের দখলেই রাখলো। জার্মানি-অস্ট্রিয়া সম্পর্কের এটা প্রথম বড় কোন অগ্রগতি ছিল। কিন্তু এর ফলে দুইটা বড় সমস্যা দেখা দেয়: ১. সার্বিয়া আবারো অস্ট্রিয়ার নিচে পড়ে থাকে এবং সার্বদের ভেতরে ক্ষোভ বাড়তেই থাকে। ২. রাশিয়া তাদের অসহায় অবস্থা থেকে সরে আসে এবং বড় একটা সামরিক বাহিনী গঠন শুরু করে। যাতে এরপর সার্বিয়া যদি আবার কোন সাহায্য চায় তবে তারা যেন সাহায্য করতে পারে। আগাদির সমস্যা, ১৯১১ সাল এটা ছিল মরক্কো সমস্যারই একটা পরিবর্তিত রূপ। ফ্রান্সের ট্রুপস মরক্কোর রাজধানী 'ফেজ' দখল করে যাতে সুলতানের বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহ করা যায়। ফ্রান্স মরক্কোকে তাদের বর্ধিতাংশ বানাতে চেয়েছিল। অন্যদিকে জার্মানি তাদের সশস্ত্র জাহাজ 'প্যানথার' মরক্কোর 'পোর্ট অফ আগাদির' এ প্রেরণ করে। তারা আশা করছিল যে তারা ফ্রান্সের উপর চাপ দিয়ে মরক্কো'র পালটা দখল নিবে, সেই সাথে ফরাসি কঙ্গোও দখলে আনবে। আগাদির জার্মানদের দখলে যাওয়ায় ব্রিটেন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে কারণ এতে তাদের ট্রেড রুট হুমকির মুখে দাঁড়ায়। এর প্রেক্ষিতে ব্রিটেনের Chancellor of Exchequer, লয়েড জর্জ একটি ভাষণ দেন, যেখানে তিনি জার্মানিকে সতর্ক করে বলেন যে, যেখানে ব্রিটেনের সার্থে আঘাত করা হবে সেখানে ব্রিটেন দাঁড়িয়ে থাকবে না বরং সামনে বাড়বে।

 এদিকে ফ্রান্সও তাদের অবস্থানে অনড় ছিল। শেষ পর্যন্ত জার্মানি আগাদির থেকে তাদের গানবোট সরায়। এটা অক্ষশক্তির একটা বড় জিয় ছিল। এরপর প্রথম ও দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ ১৯১২-১৯১৩ যুদ্ধটা শুরু হয় যখন সার্বিয়া, গ্রিস, মন্টিনেগ্রো এবং বুলগেরিয়া (যারা 'বলকান লীগ' হিসেবে পরিচিত ছিল), তুরস্কে আঘাত করে। জলদিই জার্মান সরকার এবং ব্রিটেন ফরেইন সেক্রেটারি স্যার এডওয়ার্ড গ্রে লণ্ডনে একটি শান্তি সম্মেলনের আয়োজন করেন যেটা শেষ হয় তুরস্ককে বলকান লীগের দেশগুলোর মধ্যে ভাগ করে দেয়ার মাধ্যমে। কিন্তু এ নিয়ে সার্বিয়া খুশি ছিল না। তারা আলবেনিয়া চেয়ে বসে যাতে তারা সহজেই সমুদ্রপথ ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু অস্ট্রিয়া জার্মান এবং ব্রিটেনের সহযোগিতায় ঘোষনা করে যে আলবেনিয়া একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই থাকবে। সার্বিয়াকে শক্তিশালি হওয়া থেকে বিরত রাখাতে এটা অস্ট্রিয়ার আরেকটি জয় ছিল। এরপর দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ শুরু হয় যখন বুলগেরিয়া তাদের প্রাপ্তি নিয়ে অখুশি হয় এবং মেসিডোনিয়াকে চেয়ে বসে। বুলগেরিয়া সার্বিয়াকে অ্যাটাক করে কারণ এর বেশিরভাগ অঞ্চল সার্বিয়ার ভাগ্যে পরে। কিন্তু বুলগেরিয়ার পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয় যখন গ্রিস, তুরস্ক, এবং রোমানিয়া সার্বিয়াকে সহযোগিতা দেয়। বুলগেরিয়া পরাজিত হয় 'বুখারেস্ট চুক্তি ১৯১৩' দ্বারা যেটাতে বুলগেরিয়া প্রথম যুদ্ধ থেকে তারা যা পেয়েছিল তাই হারায়। কিন্তু এখানে দু'টো সমস্যা দেখা দেয়। ১. অস্ট্রয়া সার্বিয়ার এ জয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। ২. অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির মাঝে বসবাসরত সার্ব এবং ক্রোটরা হুমকির মুখে পড়ে যায়। ইতোমধ্যে সার্বিয়া এবং অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির দ্বন্দ্ব এবং অন্যদিকে ব্রিটেন-ফ্রান্সের সাথে জার্মানির বিভেদ চরমে পৌছে গেছে। বিশ্ব তখন যুদ্ধের দ্বারপ্রান্ত। শুধু একটি উপলক্ষ বাকি। এই উপলক্ষটুকুও শিঘ্রই এসে গেল। ১৯১৪ সালের ২৮ জুন। বসনিয়া ভ্রমণকালে বসনিয়া'র রাজধানী সারজেভোতে "গার্ভিলো প্রিন্সিপ" নামে একজন অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক "ফ্রাঞ্জ ফার্ডিন্যান্ড" এবং তার স্ত্রীকে গুলি করে হত্যা করে। পরে সে স্বীকার করে সে একজন সার্ব। অস্ট্রিয়া এতে সার্বিয়াকে দোষী বলে দাবি করে এবং সার্বিয়ান সরকারকে আল্টিমেটাম দেয়। সার্বিয়ান সরকার অস্ট্রিয়ার রিপোর্টের বেশিরিভাগ পয়েন্টই স্বীকার করেছিল। কিন্তু জার্মানির সমর্থনে অস্ট্রিয়া এই ঘটনাটিকে যুদ্ধ শুরুর কারণ হিসেবে চালাতে চেয়েছিল। অবশেষে ২৮ জুলাই অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে। অস্ট্রিয়া আবার সার্বিয়ার উপর চরাও হওয়াতে এবার রাশিয়া সার্বিয়ার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং তাদের সৈন্য সাজাতে নির্দেশ দেয় সেনাবাহিনীকে। জার্মানি এটা বন্ধ করতে বলে কিন্তু রাশিয়া তা উপেক্ষা করে। ফলে ১ আগস্ট রাশিয়া এবং ৩ আগস্ট ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

 যখন জার্মান সৈন্যরা ফ্রান্স অ্যাটাক করার জন্য বেলজিয়ামের পথকে বেছে নেয় তখন ব্রিটেনও নড়েচড়ে বসে। কারণ ১৮৩৯ সালে বেলজিয়ামের সাথে চুক্তি অনুযায়ি বেলজিয়ানকে নিরপেক্ষ রাখতে ব্রিটেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল। কিন্তু জার্মানি ব্রিটেনের নিষেধ অমান্য করায় ব্রিটেন ৪ আগস্ট যুদ্ধে প্রবেশ করে। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি এবার ৬ আগস্ট রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে। অন্যান্য দেশগুলো আরো পরে যুদ্ধে যোগ দেয়। "মনরো মতবাদ" অনুসরণ করে যুক্তরাষ্ট্র এ যুদ্ধ থেকে বিরত ছিল। অন্য মহাদেশে যুদ্ধের ব্যাপারে তারা আগ্রহী ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৯১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র অক্ষশক্তি সাথে যুদ্ধে যোভ দেয়। মানবজাতির ইতিহাসে এ যুদ্ধের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। এটা ছিল মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। অথচ যুদ্ধের পিছনে কারণটা আর কিছুই ছিল না। ছিল শুধু ক্ষমতার লোভ। "মনরো মতবাদ" এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি নিয়ে এরপরের কোন লেখায় আলোচনা করব। আজ এ পর্যন্তই শেষ করলাম।

বিবলিওগ্রাফি:
১. International Relations between two world 1919-1939 war by E.H. Carr ২. Mastering Modern World History by Norman Lowe ৩. History of International Relations by Abdul Halim এবং উইকিপিডিয়া।

রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

প্রাচীন ঐতিহ্য পালকি

প্রাচীন ঐতিহ্য পালকি

কালের বিবর্তনে কতো কিছু পাল্টায়—পাল্টায় সংস্কৃতি, সভ্যতা সেই সঙ্গে পাল্টে যায় মানুষের জীবনধারা। এ পরিবর্তনের রেশ ধরেই হারিয়ে যায় সংস্কৃতির সুপরিচিত অনেক পুরনো ঐতিহ্য। এই হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের মধ্যে পালকি অন্যতম।




‘পালকি চলে, পালকি চলে, গগনতলে আগুন জ্বলে’... তাছাড়া আরো সুন্দর ছন্দবদ্ধ কথা' তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে ...।’ পালকি আমাদের দেশের জাতি, ধর্ম, বর্ণ সবার কাছে সমান পছন্দনীয় ছিলো। এটি আমাদের দেশের হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্য। পালকি নিয়ে লেখা হয়েছে গান, ছড়াসহ কতো শত কবিতা। ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক কবি পালকি নিয়ে লিখেছেন।

এক কালে এদেশের জমিদার-নবাবসহ সমাজের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা কোথাও যাতায়াত করলে পালকি ছাড়া চলতোই না যেন। তাদের সামান্য পথটুকু চলতেও পালকি লাগতো। যেমন—তাদের খাসমহল থেকে ঘোড়ার পিঠ পর্যন্ত বা পানসি ঘাট পর্যন্ত যেতেও পালকি ব্যবহার করা হতো। এ তো গেলো এক শ্রেণীর লোকদের কথা। এরা ছাড়াও সমাজের জ্ঞানী-গুণী মানুষদের বরণ করতে তত্কালে পালকির বিকল্প যেন পালকিই ছিলো। সে আমলে বিদেশি কোনো মেহমান এলেও তাকে পালকিতে চড়িয়ে বরণ করা হতো। যেমনটা করা হয় বর্তমান দিনে অতিথিদের সম্মানে মোটর শোভাযাত্রায়। সে যা হোক, পালকির কথা সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তার এদেশে আসা ভ্রমণ কাহিনীতে। তার লেখার মধ্যে এ কথাও পাওয়া যায় যে, তিনি পালকি বহনের দৃশ্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন।

তখনকার দিনের বিয়ে এবং পালকি এ যেন ছিলো একই সুতোয় গাঁথা। আমাদের দেশে এমন এক সময় গেছে যখন বিয়ের অনুষ্ঠান পালকি ছাড়া হতোই না, পালকি ছাড়া বিয়ে অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলে যেন নিজেদের হতভাগা বলে মনে করা হতো। নতুন বউ তুলে দেয়া হতো বরের বাড়িতে পালকিতে করে। আবার এ বিয়ে উপলক্ষে পালকি সাজানো হতো মনোলোভা ও দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্যে। সব পরিবারে আবার পালকি ছিলো না। তখনকার দিনে বিত্তশালী ও উচ্চবংশীয় লোকদের প্রত্যেকের বাড়িতে পালকি ছিল বংশের মর্যাদার প্রতীক। সাধারণ পরিবারের লোকদের বাড়িতে পালকি ছিল না বললেই চলে। তাই বলে তাদের উত্সব পার্বণ পালকি ছাড়া হতো তা কিন্তু নয়। তাদের জন্য অন্য ব্যবস্থা ছিলো। সে সময়ে কিছু কিছু মানুষ এ পালকি নিয়ে বাণিজ্য করতো, মানে পালকি বানিয়ে অর্থের বিনিময়ে চুক্তিতে দিতো। এ জন্য পালকি মালিকদের দিতে হতো মোটা অংকের কড়ি বা টাকা অথবা তার সমতুল্য অন্য কোনো জিনিস।

পালকিকে ঘিরে আরো কিছু লোক জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতো। এ লোকদের বলা হতো ‘কাহার’ বা ‘বেহারা’। যেদিন তাদের দরকার হতো তার আগে ‘বায়না’স্বরূপ মাইনে দিতে হতো। বিয়ের অনুষ্ঠানের দিন বিয়ে বাড়িতে তাদের খাওয়ানো হতো জামাই আদরে। এছাড়া তাদের সম্মানী দিতে হতো বরপক্ষ থেকে।

মেয়ে বাবার বাড়িতে নাইওর যেতেও ব্যবহার করতো পালকি। পালকিতে চারজন বেহারা বা কাহার প্রয়োজন হতো। গ্রামগঞ্জে অন্যান্য লোকালয়ে পালকিতে করে বউ নেয়া, দৃশ্য চোখে পড়তো। পালকির দরজার ফাঁক দিয়ে নতুন বউটি বাইরে দৃষ্টি দিতো কান্না ভেজা চোখে। যখন বেহারারা বউ নিয়ে যেত গ্রাম থেকে গ্রাম পেছনে ফেলে, তখন তাদের কণ্ঠে চলতো পালকি বহনের গান—‘হুন হুনা হুন হুনরে’ বা ‘চার বেহারার পালকি চড়ে যায় রে কন্যা পরের ঘরে।’ আরো এরকম হৃদয় ছোঁয়া গানে গ্রামগঞ্জ যেন জেগে উঠতো নতুন প্রাণে। তাদের পালকি বহনের সময় পা ফেলার আলাদা তাল বা ছন্দ ছিলো। সেই ছন্দ আর তালের সঙ্গে নিজস্ব গানে গানে কাঁধে নিয়ে বইতো পালকি।

এখন আর আমাদের গ্রামগঞ্জ, শহর, বন্দরে দেখা যায় না পালকি বহনের দৃশ্য। পালকি এখন স্থান পেয়েছে জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য। পালকির সেই ঐতিহ্যময় ব্যবহার ক্রমে গ্রাস করেছে যান্ত্রিক সভ্যতার বিদেশি নানান রংয়ের বাহারি গাড়ি। পালকি বহনের দৃশ্য এখন যেন স্বপ্ন। সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছে ছন্দমাখা পালকি বহনের গান।

প্রাচীন ঐতিহ্য ঢেঁকি

প্রাচীন ঐতিহ্য ঢেঁকি

কালের আর্বতনে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী শিল্পগুলো। তেমনি গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি শিল্প আজ হারিয়ে যাচ্ছে।  গ্রামের ঘরে এখন আর এগুলো আগের মত চোখে পড়ে না। ভোরে আজানের সাথে সাথে স্থদ্ধতা  ভেঙ্গে ঢেঁকির শব্দ এখন আর ছড়িয়ে পড়েনা চারিদিগে। চোখে পড়ে না বিয়ে সাদির উৎসবে ঢেঁকি ছাটা চালের ক্ষির পায়েস রান্না। অথচ একদিন গ্রাম ছাড়া ঢেঁকি কিংবা ঢেঁকি ছাড়া গ্রাম কল্পনা করাও কঠিন ছিল। যেখানে বসতি সেখানেই ঢেঁকি কিন্তু আজ তা আমাদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য থেকে মুছে যাচ্ছে। এই গ্রাম বাংলার ঢেঁকি নিয়ে কবি – সাহিত্যিক রচনা করেছেন কবিতা গল্প। বাউলরা গেয়েছেন গান। আগে গ্রামের প্রায় বাড়িতেই ঢেঁকিতে ধান ভানতো। জীবিকা অর্জনের মাধ্যম ও ছিল। 

ছবি: গ্রামের নারীদের চাল ভাঙ্গানোর দৃশ্য

এটা পূর্বের তুলনায় তা আজ দেখা যায় না। অনেকই এ পেশায় জড়িত ছিল। বর্তমানে তারা পেশাচ্যুত। তাদের অনেকেই এখন কষ্টে দিনাতিপাত করছে। এই পেশায় নিয়োজিত শ্রমিকদের বলা হয় তারানী। আগে ঢেঁকি শিল্পে জড়িত ছিল অনেকে। এরা সবাই বাধ্য হয়ে অন্য পেশা  বেছে নিয়েছেন। কেউ কাঁথা সেলাই কেউবা দর্জির কাজ করেন , আবার কেউ কেউ ভিক্ষা বৃওি ও ঝি-এর কাজ করছে। করছে হাঁস- মুরগী পালন। গ্রামের লোকেরা এখন আর আগের মতো ঢেঁকিতে ধান ছাটাই করে না। প্রায় গ্রামে মিনি রাইস মিল গড়ে উঠেছে। গ্রামাঞ্চলের ছেলেমেয়েরা এখন লেখাপড়া শিখছে। তাই বড়দের এখন কেউ ঢেঁকিতে পাড় দিতে দেয় না। তা ছাড়া মেয়েরা যদি একটু লেখাপড়া জানে তবে শ্বশুর বাড়ি এসে ঢেঁকিতে পাড় দিতে ধান ভানতে চায় না। সেজন্য গ্রামে এখন ঢেঁকি দেখা যায় না। গ্রাম-গঞ্জেএখন শত শত মিনি রাইস মিল গড়ে উঠেছে। মানুষ শিক্ষিত হয়েছে। রুচি ও গেছে বদলে। ফলে ঢেঁকি অস্তিত্ব আজ বিলুপ্তির দ্বার প্রান্তে প্রায়। হাজার হাজার বিধবা তালাক প্রাপ্ত এবং গরীব মহিলাদের জীবিকা অর্জনের একমাত্র সম্বল ছিল এই ঢেঁকি। গ্রামে গেলে কারো কারো বাড়িতে ঢেঁকি দেখা যায়। কিন্তু এতে এখন আর ধান ভানা হয় না। গোয়াল ঘরে কিংবা অন্য কোথাও পরিত্যক্ত রয়েছে। হয়তো এমন একদিন আসবে যখন ঢেঁকি দেখার জন্য হয়তো বা যাদুঘরে যেতে হবে।

                                                    ছবি: গ্রামের নারীদের চাল ভাঙ্গানোর দৃশ্য

বুঝাতে হবে কিভাবে ঢেঁকিতে ধান ভাঙ্গানো হত।  সভ্যতার প্রয়োজনে ঢেঁকির আর্বিভাব ঘটেছিল। আবার গতিময় সভ্যতার যাত্রা প্রযুক্তিগত উৎকষই ঢেঁকি বিলুপ্তি করে দিয়েছে। একে না মেনে উপায় নেই।  মহিলারা সংসারে শত  অভাব অনটনের ভিতরে ও নিজেদের ক্লান্তি ঢাকার জন্য ঢেঁকির তালে তালে গান গেয়ে  ধান ছাঁটাইয়ের কাজ করতো। এক দশক আগেও  গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে ঢেঁকি চোখে পড়ত। গৃহস্থের বাড়িতে একাধিক ঢেঁকি থাকতো ঘরের পাশে বাড়তি একটি চাল দিয়ে তৈরি করা হত ঢেঁকি রাখার ঘর। গ্রামের মহিলাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলতো কে কত ভোরে উঠে ঢেঁকিতে পা দিতে পারবে। এবং কে কত বেশি ধান ছাঁটাই করতে পারে। কৃষক বধূর ঢেঁকির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যেতো কৃষকের। কৃষক লাঙ্গল কাধে গর্ব নিয়ে ছুটতেন  মাঠ পানে। গৃহিনী হাঁস- মুরগী ছেড়ে দিতেন। এগুলো ছুটে যেতো ঢেঁকিশালার দিকে খাদ্যের সন্ধানে। ভারানীদের তাড়া খেয়ে কক শব্দ করতে করতে পালাতো সেখান থেকে।

ধান ভানার সময় মহিলাদের হাতের চুরির ঝনঝন শব্দ হত। শব্দ হতো পায়ের নুপুরের  সব মিলিয়ে সৃষ্টি হতো এক সঙ্গীত মুখোর পরিবেশ। ঢেঁকি কাঠের তৈরি। কুল, বাবলা, জান, গাব ইত্যাদি কাঠ দিয়ে ঢেঁকি তৈরি করাহতো। সাড়ে তিন থেকে চার হাত দৈর্ঘ্য এবং পৌনে এক হাত চওড়া। মাথার দিকে একটু পুরু এবং অগ্রভাগ সরু এর মাথায় এক হাত লম্বা একটি কাঠের তক্তা থাকে। একে বলে রেনু বা ছিয়া। এর মাথায় লাগানো  থাকে লোহার গোলা। গোলার মুখ যে স্থানটি মাটি স্পর্শ করে তাকে বলে গড়। এটা চার পাঁচ ইঞ্চি গর্ত। গর্তের ভিতরে স্থাপিতহয় কাঠের্একটি অংশ। অনেক কাঠের পরির্বতে পাথর খন্ড ব্যবহার করেন। তবে যাই ব্যবহার করা হোক না কেন সেটি হয় খুব মসৃন এই গতের্র ভেতর দেয়া হয় ধান। ঢেঁকির পেছনে ঢেঁকিতে ধান ভানতে সাধারণ দু’জন লোকের  প্রয়োজন। একজন ঢেঁকিতে ধান দেয় গাড়ের (গর্তের) ভিতর ধান নাড়াচাড়া করে। একজন পাড় দেয়। অনেক সময় বেশি ধান হচ্ছে তা দু’জনের দ্বারা হয়ে উঠে না, তখন তিনজন লাগে। দু’জন  দু’জন একসাথে পাড় দেয়। একজনে ধান উল্ট পালট করে দেয়। এভাবে কয়েকবার ধান পাড় দিয়ে খোসা আলাদা করার পর কুলো দিয়ে ধান পরিস্কার করতে হয়। তখন বের হয় চাল। এতে যথেষ্ট পরিশ্রমও বটে। নতুন প্রজন্মের অনেকের  কাছে ঢেঁকি হয়তো অপরিচিত। ঢেঁকির নাম শুনেছেন অনেকেই কিন্তু  চোখে দেখেননি। এমন লোকও আছে। আমাদের গানেও প্রবাদে অনেকবার ঢেঁকির কথা এসেছে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম পর্যন্ত গান রচনা করেছেন। পায়ের পরশে পেয়েছে কাঠের ঢেঁকির প্রাণ। তাছাড়া ঢেঁকি নিয়ে যে প্রবাদ আছে তা আমরা অহরহ ব্যবহার করি। ,যেমন অনুরোধে ঢেঁকি গেলা। অসম্ভব কোন কাজ সম্পাদন করার ক্ষেত্রে এটা ব্যবহার হয়। অপদার্থের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় আমরা কাঠের ঢেঁকি।  ঢেঁকি শিল্পের শব্দের প্রতিধবনি গ্রাম বাংলার চিহ্নিত হয়ে উঠে ঐতিহ্যবাহী শিল্প হিসেবে।